Looking For Anything Specific?

ads header

অমর সৈনিক - দেবাশীষ ভট্টাচার্য | Amar Sainik - Bangla Golpo by Debashis Bhattacharya

অমর সৈনিক - দেবাশীষ ভট্টাচার্য | Amar Sainik - Bangla Golpo by Debashis Bhattacharya 

bangla golpo pdf download bangla golpo book pdf bangla golpo apk bangla golpo thakurmar jhuli bangla golpo love story bangla golpo lyrics bangla golpo funny bangla golpo gopal bhar bangla golpo book online reading bangla golpo hasir thakurmar jhuli bangla golpo gopal bhar bangla golpo sarat chandra chattopadhyay bangla golpo pdf islamic bangla golpo valobashar bangla golpo valobasar bangla golpo gopal bhar bangla golpo pdf bangla bhuter golpo bangla premer golpo bangla vuter golpo bangla valobashar golpo bangla gopal bhar golpo bangla rohosso golpo pdf free download bangla vuter golpo pdf bangla valobasar golpo bangla rupkothar golpo pdf free download bangla islamic golpo bangla golpo pdf download bangla golpo book pdf bangla golpo apk bangla golpo thakurmar jhuli bangla golpo love story bangla golpo lyrics bangla golpo funny bangla golpo gopal bhar bangla golpo book online reading bangla golpo hasir thakurmar jhuli bangla golpo gopal bhar bangla golpo sarat chandra chattopadhyay bangla golpo pdf islamic bangla golpo valobashar bangla golpo valobasar bangla golpo gopal bhar bangla golpo pdf bangla bhuter golpo bangla premer golpo bangla vuter golpo bangla valobashar golpo bangla gopal bhar golpo bangla rohosso golpo pdf free download bangla vuter golpo pdf bangla valobasar golpo bangla rupkothar golpo pdf free download bangla islamic golpo

                      সৈনিকদের অভিধানে স্বর্ণের অক্ষরে লেখা সাহস এবং দেশপ্রেমের প্রতীক সুরজ সবসময় বলতো "আমার মাতৃভূমি আমার স্বর্গরাজ্য ; আমি আমাদের দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতার জন্য আমার দেহের রক্তের প্রতিটি বিন্দু দিয়ে দেবো । তার আদর্শই হলো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই এবং জয়ের লড়াই ; শত্রুদের ভয়ে পশ্চাদাপসরণ কখনও মনে স্থান দেয় না । যদিও সহজেই ভালো ইউনিভার্সিটি থেকে এম বি এ করতে পারতো যেহেতু ওর বাবা স্থানীয় ঋণদাতার কাছ থেকে ওর শিক্ষা গ্রহণের জন্য কিছু ঋণ গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু চলার রাস্তা বেছে নেয় আধাসামরিক বাহিনী | শুধুমাত্র আর্থিক উপার্জনকে জীবনের প্রধান লক্ষ্য না করে দেশ সেবার জন্য একটা দুঃসাহসিক জীবনের আনন্দ উপভোগ করাই ওর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় | সফলতার সহিত কমান্ডো প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করবার পর দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য উচ্চ ঘন জঙ্গল আচ্ছাদিত ছত্তিশগড়ের এক দুর্গম এলাকায় ওকে চাকরি করবার সুযোগ দেওয়া হয় । কলেজে শিক্ষা গ্রহণের সময় রোশনীর সাথে ওর এক নিবিড় প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, রোশনী পড়াশুনা করছিলো এক স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের জন্য। চাকরিতে যোগদানের পর কঠোর পরিশ্রমের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে ছুটি নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে বিকালে রোশনীর সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয় | দীর্ঘদিনের পর স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশা নিয়ে রোশনী ওর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো | অনেকদিন পরে ওকে দেখে আনন্দে খুব উত্তেজিত হয়ে বললো, "ওহ ! তুমি সূর্যের গতি পরিবর্তন করে একবারে ব্রেভ ওয়ারিয়র হয়ে গেলে ? "


সুরজ : আমি দেখেছি আপনিও বদলে গেছেন ; আপনি একজন স্কুল শিক্ষিকার মত হয়ে গেছেন, অবশ্যই আপনার মাস্টার ডিগ্রির পরে শিক্ষার্থীদের যখন শেখাবেন তখন আমি আপনার প্ররোশনী : সুরজ, তুমি আমার সঙ্গে মজা করছো ? কেন আমি একজন শিক্ষিকা হতে যাবো ? আমি তো একজন সাহসী যোদ্ধা বা বীরের সহযোগী হয়ে তার পাশে পাশে সবসময় থাকতে পারি সুরজ : একবার চিন্তা করো রোশনী, একজন বীর যোদ্ধার জীবন খুবই কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ ; যে কোন সময় অশুভ ঘটনা ঘটতে পারে ।


রোশনী : হ্যাঁ, আমি একবার যাকে গ্রহণ করি তাকে কখনো পরিত্যাগ করি না, এটা কোনো জীবন নয় যেখানে কোন সাহসিকতা নেই, কেবল খাওয়া-দাওয়া, অর্থ সঞ্চয় আর ঘুম - এটাই কি জীবন ? আমার কাছে এইরখম জীবনের কোনো মূল্যই নেই | আমি চাই সেইরখম জীবন যেখানে মাতৃভূমির ও দেশবাসীর জন্য কিছু করা যায় |


সুরজ : তুমি খাওয়া-দাওয়া, ঘুমোনো ছাড়া আর কি কি করতে চাও?


রোশনী : হ্যাঁ, আমি দেশবাসীর জন্য কিছু করতে চাই, আর তুমি বোলো তো আমাদের জীবনের সংজ্ঞা কি হতে পারে ?


সুরাজ : মুখটা একটু কাঁচুমাচু করে, "না, আমাকে বলো ।"


রোশনী : সুরজের দিকে তাকিয়ে, "সকলকে ভালোবাসার জন্য বাঁচো এবং সকলকে বাঁচাবার জন্য মরো ।”


সুরজ : অজশ্র ধন্যবাদ, তুমি আজ আমাকে খুব ভালো একটা ডেফিনেশন দিলে জীবনের ; চলো আমরা আবার সেই পুরানো বাগানবাড়িটাতে যাই |


একটা পুরানো বাড়ির পাশে বিরাট বাগান, একটা বড়ো অশত্থ গাছের নীচে বসে সুরজ তার গত দুই বছরের সৈনিকের জীবনের বর্ণনা দিতে থাকে ; কিছুক্ষন পরে হঠাৎ রোশনী উঠে দাঁড়ায় এবং গাছের ছালের উপর পাথরের চিপ দিয়ে কিছু


লিখতে চেষ্টা করে ; সুরজ দেখতে পায় ওর নামটা রোশনী লিখেছে অত্যন্ত্য মনোযোগ সহকারে ; তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে পাথরের চিপটা টেনে নিয়ে সুরজ নামের পাশে রোশনী লিখে পাথরের চিপটা ফেরত দেয় | বেশ কিছুক্ষণ চাকরির অসুবিধার বিষয়ে বোঝাবার চেষ্টা করে, কিন্তু সবই বৃথা, ওর দৃঢ়তার সামনে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা থাকে না | একজন সহধর্মিনী হয়ে সুরজের জীবনের প্রতি পদক্ষেপে তাল মিলিয়ে চলতে ও প্রস্তুত | এক বৎসর ঘুরতে না ঘুরতে সুরজ এবং রোশনীর মধ্যে শুভ পরিণয় সুসম্পন্ন হয়, প্রথম অবস্থায় এরূপ দুর্গম অঞ্চলে গিয়ে বিপদ হতে পারে জেনেও স্বামীর পাশে থেকে সমস্ত দায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত নেয় রোশনী |


পার্বত্য এলাকার রাস্তা দুর্গম হওয়ায় কনভয় ছাড়া যাবার কোনো উপায় নেই, দীর্ঘ ১২ ঘন্টা পাহাড়ি সড়ক রাস্তার ওপর দিয়ে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা না থাকলেও সুরজের কাছে আগে শুনেছে | আজ ওর পাশে টাটা সুমোতে বসে সেই দুর্গম রাস্তায় যাত্রা করছে, আগে পিছনে চলেছে অনেক ট্রাক, বাস এবং বিভিন্ন ছোট-বড়ো গাড়ি সরু-সরু পাহাড়ি রাস্তা অতিক্রম করে | আস্তে আস্তে 4 হাজার ফুটের বেশি পাহাড়ের উপরে পৌঁছায় যেখানে যানবাহনের পাস্ দিয়ে এবং পাহাড়ের গা ঘেঁষে সাদা-সাদা তুলোর মতো মেঘগুলো ভেসে যাচ্ছে, বাহঃ কি সুন্দর দৃশ্য !... .. মেঘগুলি আমাদের কত কাছাকাছি; 'দাঁড়াও..দাঁড়াও..আমি একটু মেঘ ধরবো' এই বলে জানালার বাইরে ওর বাম হাতটা বের করে হাতের সরু-সরু আঙ্গুলগুলো জড়ো করে একবার মুঠো করে আবার একবার খোলে আর বলে, কই..এত শুধু জলের মতো ভেজা ; ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে সুরজ চিন্তা করছিলো সন্ধ্যার আগে পৌঁছে কি করে তাড়াতাড়ি ঘর-দোর জোগাড় করে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করবে আর পরের দিনের ডিউটিতে যোগ দেবে ! হঠাৎ রোশনীর ডান হাতের একটু খোঁচা খেয়ে ঘাড়টা 45 ডিগ্রী ঘুড়িয়ে উত্তর দেয়, "আমি আগে এগুলো দেখে নিয়েছি, এখন তুমি উপভোগ


করো আর যতটা ইচ্ছা মেঘ সংগ্রহ করে একটা বোতলের মধ্যে সংরক্ষণ করে রেখে দাও, যাতে সময়মতো তোমার মাথার ওপর আমি ঢেলে দিতে পারি ; কিছুদিন পরে তুমি বলবে আমাকে এই পাহাড় থেকে নিয়ে চলো এখানে আনন্দের কোনো উৎস নেই |


রোশনী : ধ্যুত, তুমি একজন খরুশ ব্যাটাছেলে, এত সুন্দর প্রকৃতি, কত সুন্দর সাইট সিনারি, কোথা উপভোগ করবে, তা নয় শুধু গোলাগুলির চিন্তা |


সুরজ : একটু হেসে, অরে না বাবা, এগুলো তো আমার রোজ রোজ দেখতে দেখতে চার্মটাই শেষ হয়ে গেছে, তুমি তো প্রথম দেখছো, তাই এত ভালো লাগছে |


রোশনী : দ্যাখো, তোমার সৌন্দর্য জ্ঞান একটু কম কারণ সবসময় যুদ্ধ সম্পর্কে চিন্তা; আচ্ছা আমাকে একবার বলোতো তোমার কি যেন কম্পানি আছে, তার পাশে কি কোনো water-fall আছে ?


সুরজ : প্রশ্নগুলো শুনে একটু আশ্চর্য লাগে আর ভাবে কত সহজ সরল জীবন যাপন করতো, কিন্তু এখন যেখানে যাচ্ছে সেখানে গিয়ে কি দেখবে আর ভাববে কে জানে ! একটু মজা করবার জন্য যেনো কানে কম শুনেছে এই ভাব দেখিয়ে, কি ফল দেখতে যাবে বলছিলে ?


রোশনী : ও, তুমি কি অগে ওয়াটার ফল শুনোনি মনে হচ্ছে ?


সুরজ : শুনেছি, তবে তোমার মুখ থেকে বাংলাটা শুনতে চাইছি |


রোশনী : থাক, এত কথার আর দরকার নেই, তুমিই বাংলাটা বলে কোথায় কি আছে শুনাও |


সুরজ: বেশ, তোমাকে নতুন বাংলা শুনাচ্ছি, "আমি তোমাকে পানির পতন দেখতে নিয়ে যাবো |"


রোশনী : হেসে লুটোপুটি খেয়ে, হ্যাঁ মডার্ন বাংলা, আমরা আর কোথাও যাবো না, শুধু পানির পতন দেখতে যাবো |


হঠাৎ কিছু দূরে সত্যি সত্যি একটা ছোট-খাটো ঝর্ণা বইতে দেখে আনন্দে অধীর হয়ে বলে উঠে, "এই চলো না, চলো না, গাড়িটা দাঁড় করিয়ে আমরা ছুটে গিয়ে ওই water-fall টা বা তুমি যে বললে “পানির পতন” একবার দেখে আসি |


সুরজ : একটু কৌতুক করে, ঠিক আছে, চলো এখন আমরা সেই জল পড়ার দিকেই অগ্রসর হই কারণ আমার কাছে কোন কাজ বা চাকরি নেই এক্ষুনি জল দেখতে হবে আর তুমি যত ইচ্ছে পান করতে পারো ।


রোশনী : একটু আত্মসম্মানে লাগে এবং বলে উঠে সুরজ, আমি কখনোই বলিনি যে আমার জল পড়া না দেখলে চলবে না, রাস্তায় যেতে যেতে এরখম দুকথা হয়েই থাকে, তাবলে সব কিছুকে সিরিয়াস করে নিও না | আমি বলতে চেয়েছিলাম যেখানে তুমি থাকো সেখানে ওয়াটার ফল আছে কি না ; তারপর থেকে তুমি শুধু একের পর এক কথা পাল্টাচ্ছ | এটা আমার জীবনে প্রথম ট্যুর যখন আমি আমার লাইফ পার্টনারের সাথে ভ্রমণ করছি সেখানে কেউ বা কিছুই আমাদের বাধা বা বেড়া হতে পারে না |


সুরুজ : একটু গম্ভীরভাবে দেখিয়ে, তুমি তো আমাদের কমান্ডারকে জানো না যিনি সর্বদাই প্রতি সেকেন্ড গণনা করেন আমি এবং আমার সহপাঠীরা কিভাবে কাজ করছি। আমার বড় বেড়া আমার কমান্ডার; তার অনুমতি ব্যাতিতো আমি কিছুই করতে পারি না, তবে তুমি তো স্বাধীন ; তোমার না আছে কোনও বেড়া বা সীমানা যা তোমার অবস্থানকে সাবধান বা বিশ্রাম করাতে পারে। তাই তোমার কোনো চিন্তাও নেই |


রোশনী : সাথে সাথে ভুলে যাবেন না মহাশয়, আপনার কমান্ডার আপনার চাকরিতে বেড়া, কিন্তু আপনি যখন ঘরে ফিরে আসবেন তখন আমি ঘরে একটা হার্ড বেড়া হয়ে থাকবো |


সুরজ : সে কি, তুমি আমার বেড়া হয়ে থাকবে ? তাহলে আমি কি একটা বেড়া তুলে নিয়ে যাচ্ছি এত দূর থেকে ? হায়..হায়.. আমার জীবনে শান্তি কোথায়...when better half is a fence ..


রোশনী : oh ..ho ..sorry ..sorry .., আমি তো ভুলেই গিললাম যে আমার বিয়ে হয়ে গেছে..


সুরজ : ঠিক আছে ম্যাডাম, গতকালের আগের দিন পর্যন্ত তুমি ছিলে আমার প্রেমিকা, আর বিয়ে করবার দুদিন পর হয়ে গেলে একটা বড়ো বেড়া ; তাহলে তো আমি তোমার সাথে বিয়ে করে বড় ভুল করেছি। গতকাল আমি শুধু একটা বেড়ার সম্মুখীন হতাম, কিন্তু এখন দেখছি আমাকে দুটো বেড়া অতিক্রম করতে হবে |


রোশনী : গর্বের সঙ্গে, এখন থেকে বাড়ির বেড়াটাকে বেশি প্রাধান্য দেবে, কারণ চাকরির বেড়া ritirement পর্যন্ত, কিন্তু ঘরের এই বেড়া যতদিন মৃত্যু না হয় তোমার সাথে সাথে থেকে তোমায় দেখে রাখবে, অবশ্য তোমার চাকরির বেড়াকে অতিক্রম করবার একটা উপায় আছে আমার কাছে .....


সুরজ : কৌতূহল হয়ে রোশনীর উজ্জ্বল মুখমন্ডলের দিকে একদৃষ্টিতে বিভোর হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে তুমি কি আমায় বলবে সেই উপায়টা কি ?


রোশনী : একটু হাসি-হাসি মুখে না....না, সবসময় কি সব উপায় বলা যায় ?


সুরজ : উহু..যদি এই উপায়টা বলে দিতে পারো, তবে এই বান্দা তোমার বেড়া কোনোদিনও টপকাবে না, সারাজীবন তোমার বেড়ার মধ্যেই থাকবে |


রোশনী : ঠিক বলছো ? অবশ্য চাইলেও এই বেড়া তুমি অতিক্রম করতে পারবে না |


সুরজ : বেশ তো, আমাকে তাড়াতাড়ি উপায়টা তো বলো ?


রোশনী : এত অধীর হচ্ছ কেন, একটু চোখে ইশারা করে কাছে আসতে ; ড্রাইভারের কাছ থেকে একটু সড়ে সুরজ রোশনীর কাঁধের কাছে মাথাটা নোয়াতে, রোশনী দুটো চোখ আলতো করে বন্ধ করে কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলে, "আমার ভালোবাসা" ; সুরজ খানিক্ষন মাথাটা ঐভাবেই রেখে দেয় |


হঠাৎ গাড়ির একটা জোর হর্ণের আওয়াজে সুরজের বুকটা ধড়াস করে উঠে এবং সোজা হয়ে বসে তাকিয়ে দেখে গাড়িটা একটা গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করেছে যেখানে দিনের বেলাতেও সূর্যের আলো পৌঁছায় না ; গাড়ি চালানোর জন্য দিনের বেলাতেও আলো জ্বেলে রাখতে হয় , সহসা এক বমের বিস্ফোরণের আওয়াজে রোশনী ভয়ে-আতঙ্কে ঘাবড়ে গিয়ে দু হাত দিয়ে সুরজকে জড়িয়ে ধরে মাথাটা ওর বুকের মধ্যে গুঁজে দুচোখ বন্ধ করে রাখে |


সুরজ : মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা দিতে দিতে, এখান থেকে আমাদের এলাকা শুরু হয়েছে ; তুমি নিয়মিত মর্টারের ফায়ারিং এর শব্দ শুনতে পাবে ।


রোশনী : নিজেকে সাহসী প্রমান করবার জন্য, এটা আমার কাছে বড়ো একটা সমস্যা নয় কারণ আমি তোমার অর্ধাঙ্গিনী ।


সন্ধ্যা হবার কিছু আগে, বিকাল পাঁচটা নাগাদ গাড়িটা একটা ক্যাম্প এরিয়াতে প্রবেশ করলো, চারিদিকে সান্ত্রী এস আল আর রাইফেল নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে ; অনতিদূরে সাজানো-গোছানো বেশ বড়ো একটা তাঁবু | সুরজ রোশনীকে আঙ্গুল দেখিয়ে ইশারা করে বললো এটা আমাদের কমান্ডারের কার্যালয়, এখানে আমি একটু জানিয়ে তোমার কাছে ফিরে আসছি, তারপর একসাথে আমরা


কিছু দূরে একজন ঘর দেখে রেখেছে, সেখানে যাবো ; তুমি গাড়িতে একটু বসো |


সুরজ ওর কমান্ডার মিস্টার জোসেফের কাছে যেতেই, ওকে ওয়েলকাম জানায়, যখন শুনলো ওর স্ত্রী গাড়িতে বসে আছে, তাড়াতাড়ি নিজে চেয়ার থেকে উঠে রোশনীকে অভর্থনা জানায় এবং ওর তাঁবুতে প্রবেশ করতে অনুরোধ করে | রোশনী একটু লজ্জা-ভয় এবং সংকোচ নিয়ে সুরজের সঙ্গে তাঁবুতে ঢুকে জোসেফের টেবিলের সামনে দুটো চেয়ারে বসে | জীবনে প্রথম এরখম তাঁবু দেখে ভাবে বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবে না ভেতরটা এত সুন্দর ; চারিদিকে কাপড়ের নকশা করা, কাপড়ের দরজা, কাপড়ের জানালা, বেশ কয়েকটা ঘরও রয়েছে, ডাইনিং রুমটা যেখানে ও বসে আছে বেশ বড়ো | কিছুক্ষন পরেই প্লেটে করে কিছু মিষ্টি, সিংড়া, জিলিপি ও বিস্কুট সাথে কফি একজন আর্দালী এসে ওদের সামনে টেবিলে রেখে দেয় ; জোসেফ অনুরোধ করে রোশনী ও সুরজকে খাবার জন্য, সকলে একসাথে কফি খেতে থাকে | মিস্টার জোসেফ বলতে থাকে সুরজের অনুরোধেই উনি বাইরে থাকবার অনুমতি দিয়েছেন, কেননা এইরখম এলাকাতে একাকী পরিবার নিয়ে থাকা খুব একটা নিরাপদ নয় , ওরা যেনো সাবধানে থাকে ; তবে কোম্পানির সান্ত্রীরা সবসময় খোঁজখবর নেবে | এরপর ওদের নুতন বিবাহিত জীবনের সফলতা কামনা করে শুভেচ্ছা জানায় | রোশনী ও সুরজ দুজন সান্ত্রীকে সাথে নিয়ে ওদের গাড়িতে উঠে ক্যাম্প ত্যাগ করে খানিকটা পাহাড়ি রাস্তা ধরে এগিয়ে যায়, কিছুদূরে বেশ কিছু ছোটোখাটো বাড়ি যেখানে ওদের জন্য একটা ঘর ভাড়া করে রাখা ছিলো |


একটু এগিয়ে যেতেই পাহাড়ের ওপরে কিছুটা সমতল এলাকাতে বেশ কয়েকটা বাড়ি চোখে পড়লো, সবগুলোই টিনের চাল এবং সিমেন্টের দেওয়াল, রোশনী ঔৎসুকতা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো এখানেই আমাদের ঘর ভাড়া নেওয়া আছে ? সুরজ মাথা নেড়ে জবাব দেয় হ্যাঁ, আপাতত আমাদের এখানেই থাকতে হবে, কেন তোমার ভয় করছে নাকি ? রোশনীর মুখে এক পরিতৃপ্তির হাসি লক্ষ্য


করলো, যেন এই সামান্যতেই ও অনেক খুশি ; মনে মনে ভাবতে লাগলো আদর্শ সহধর্মিনীর কাছে তার স্বামীর ক্ষুদ্র পর্ণকুটিরও স্বর্গ তা কেবল রামায়ণের যুগে যে সীতার চরিত্রে দেখা গিসলো এমনটা নয়, হয়তো খুঁজলে আজও দু-চারটে সীতা কোথাও না কোথাও পাওয়া যেতে পারে | একটা ছোটোখাটো ঘরের সামনে গাড়িটা দাঁড়াতেই রোশনী নেমে চুপিচুপি বল্ল, "জানো, আমার জীবনে এটা প্রথম স্বামীর ভাড়া করা ঘর, তাই ভাবছি ঘরে ঢুকবার আগে ঘরটার একটা নাম দিয়ে নেই, শব্দটা ভাঙলে পতির নীড় ; আর জুড়লে দাঁড়াবে পত্নীর |


সুরজ : ওহ, তুমি পারো রোশনী, আমি ভাবছি কিছুদিন পরে তোমায় আমার বাবা-মার্ কাছে রেখে আসবো, এরপর যখন এখন থেকে ভালো জায়গাতে বদলি হবে তখন তোমাকে নিয়ে এসে সপরিবারে থাকবো, মানে বাচ্ছাও সাথে |


রোশনী : থাক, তোমাকে আর অতো আগে ভাবতে হবে না মশাই, আমি আপাতত এখানেই জক গেড়ে বসছি ; পরের চিন্তা সময় এলে দেখা যাবে |


সুরজ : ইয়েস ম্যাডাম, আপনার ইচ্ছাই শিরোধার্য, আপনি যা বলেছেন তাই হবে |


কিছুক্ষনের মধ্যেই ওদের পাশের কুটিরে থাকা এক পরিবারের সাথে পরিচয় হয় | ভদ্রলোক চাকরি করছেন 20 বছরেরও বেশি সময় ধরে আসাম রাইফেলসে, নাম রিয়াজ এবং তাঁর স্ত্রী নাজিয়া | নব বিবাহিতা রোশনীকে দেখে নাজিয়ার খুব ভালো লাগে, তাই ছুটে আসে যদি কিছু সাহায্যের প্রয়োজন হয় | রোশনী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেই কারেন্ট চলে যায় এবং বেশ অন্ধকার দেখায়, নাজিয়া তাড়াতাড়ি ওর ঘর থেকে কয়েকটা মোমবাতি নিয়ে এসে রোশনীর হাতে দেয়, আর দুটো মোমবাতি জ্বালিয়ে ঘরটা আলোকিত করে | যার সঙ্গে কোনোদিনের পরিচয় নেই, অসময়ে তার কাছ থেকে অযাচিত উপকার পেয়ে রোশনী ও সুরজ বারবার কৃতজ্ঞতা জানায় | নাজিয়া ও রিয়াজ উভয়েই প্রতিশ্রুতি দেয় যে কোনো দরকারে


ওরা সবসময় ওদের পাশে আছে | মোমবাতির রশ্নিতে রোশনী লক্ষ্য করতে থাকে ঘরটা কতটা রশ্নিময় হয়েছে ; মোমবাতি হাতে করে ভেতরের ঘর ও বাইরের ঘর চারিদিক একবার দেখে নিয়ে বলে খুব ভালো | সঙ্গে করে আনা সমস্ত ব্যাগ-বাগিচা রোশনী ও নাজিয়া দুজনে মিলে খুলে ঘর সাজাতে নেয় ; ঘরের মালিক ওখানকার নিয়ম অনুযায়ী খাট, স্টিলের চেয়ার, কাঠের টেবিল ইত্যাদি ঘরেই রেখে দিয়েছিলো | নাজিয়া দুটো স্টিলের চেয়ার বের করে বাইরের বারান্দায় রেখে সুরজ ও রিয়াজকে বসতে দেয় | নাজিয়া রোশনীর সঙ্গে রান্নাঘর সাজাতে গিয়ে বলে চায়ের জন্য তো স্টোভ, পাউডার দুধ, চা পাতা, চিনি সবই রয়েছে , কিন্তু স্টোভ জ্বালাবার কেরোসিন তেল কোথায় ? আপনি এখানে কেরোসিন তেল ছাড়া মুদিখানার দোকান থেকে সবকিছু পেতে পারেন ; আমরা এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বাজার থেকে কেরোসিন তেল সংগ্রহ করে রাখি কারণ এই নির্জন এলাকাতে রান্নার গ্যাস ফুরিয়ে গেলে সব সময় গ্যাস পাওয়া যায় না ; আজ আর আপনি খুঁজলেও কোথাও কেরোসিন তেল কিনতে পাবেন না, বিকাল 6 টায় বাজারের সমস্ত দোকান বন্ধ হয়ে যায় | এখন এই নিয়ে আর কোনো চিন্তা করবেন না, আমরা যখন আপনাদের প্রতিবেশী এখানে আছি, তখন আজ রাতে কষ্ট করে হলেও আপনারা আমাদের সাথে একসাথে ডিনার করবেন । আমাদের এক কন্যা সোফিয়া আছে, এখন ও মামার বাড়ি নলবাড়িতে থেকে দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে, কিছুদিনের জন্য ছুটিতে ওকে এখানে এনেছিলাম ।


রোশনী : মনে মনে ভাবতে থাকে কিভাবে চলবে কেরোসিন ছাড়া, তার ওপর রাত্রে নাজিয়ার ঘরে খাওয়া দাওয়া কি ঠিক হবে ? কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে নাজিয়াকে যাতে ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা না করে, কিন্তু ওর আন্তরিকতা এতই মুগ্ধ করে যে ওকে বারণ করতে বিবেকে বাঁধে |


নাজিয়া : রোশনীর নীরবতা দেখে , যদিও আমরা মুসলিম কিন্তু আপনাদের খাদ্য সম্বন্ধে আমরা ভালো জানি। এখন আমি সকলের জন্য চা প্রস্তুত করছি, আসুন এবং আমাদের সাথে যোগ দিন, ওদের কুটিরের ভিতরে গিয়ে সকলের জন্য চা তৈরি করে সাথে বিস্কুট, কিছু মুখরোচক নোনতা এবং প্যাঁড়া ধরণের কিছু শুকনো মিষ্টি নিয়ে আসে ।


সকলে একসাথে চা খেতে খেতে বেশ গল্পে মত্ত হয়ে যায়, নাজিয়া বলে উঠে আমাদের সকলের জীবনশৈলী একইরখম, আমাদের কাজও হচ্ছে দেশের সেবা ; এক একবার এক এক জায়গায় যাই, সেখানে সেখানের মতো মানিয়ে নিয়ে চলি | এইভাবে দেখতে দেখতে আমাদের জীবনের কুড়িটা বছর পেরিয়ে গেছে, কোথাও সুযোগ সুবিধা বেশি আবার কোথাও কম | রোশনীর দিকে তাকিয়ে আমাদের চিন্তাধারা একই, এখানে কোনো জাতি, ধর্ম বা ভাষা বড়ো নয়, যুদ্ধ বা লড়াইটা হচ্ছে আতঙ্কবাদী বা দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে | আমার হাসব্যান্ড তো বহুবছর কাশ্মীরের পার্বত্য অঞ্চলে এবং ছত্তিসগড়ের ঘন জঙ্গলে বেশ কিছু এনকাউন্টারের মুখোমুখি হয়েছিল ; পরে এসে বলতো এর মধ্যেও একটা রোমাঞ্চ, আনন্দ বা satisfaction আছে, যেটা হলো দেশের জন্য তো কিছু করছি | শুধু কি হাতির মতো গলধঃকরণ আর মুশিকের ন্যায় গর্তে ঘুমোনোর নামই জীবন ; না তা হতে পারে না, জীবনের মানেই হলো দেশ, সমাজ বা মানুষের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা | আমাদের চাকরির মূলমন্ত্র বা উদ্দেশ্য এটাই |


রোশনী : বাঃ, আমার তো আপনার কথা শুনে খুব ভালো লাগলো, এরখম কাজ করেই তো আমাদের প্রত্যেকের গর্ব হওয়া উচিত যে আমরা ভারতবাসী |


রিয়াজ : আমাদের তো প্রশিক্ষণের শেষে একটা শপথ গ্রহণ করতে হয় যে আমরা জাতি, বর্ণ, ধর্ম বিশেষে কখনো কোনো ভেদভাব রাখবো না এবং দেশের প্রয়োজনে


যখন যেখানে যাবার দরকার হবে, সেখানে যাবার জন্য তৈরি থাকবো | যুদ্ধক্ষেত্রে শুধুমাত্র দেশপ্রেমের প্রয়োজন, সেখানে জাতি, বর্ণ বা ধর্মের প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে না । ভারতমাতা মানে কি সেটা কেউ কেউ গভীরভাবে চিন্তা না করে বিরুদ্ধ মনোভাব পোষণ করে থাকেন ; এটা সত্য যে ভারতমাতা বলতে কোনো নারীকে বোঝায় না, ভারতের মাটিকে পবিত্র বলা হয় কারণ আপনি, আমি এবং সবই এই মাটিতে জন্মগ্রহণ করে এই সুন্দর পৃথিবীতে মানব জীবন সার্থক করতে এসেছি , তাই আমরা একে ওপরের সঙ্গে ভাই- বোন-কুটুম্বের সম্পর্ক বজায় রাখার উদ্দেশ্যে মহান ভারতকে অর্থাৎ আমাদের ধরিত্রীর পবিত্র ধুলিকণাকে ভারতমাতা সম্বোধন করে সম্মান জানাই মাত্র ।


রিয়াজ এবং নাজিয়ার কাছ থেকে এরূপ দেশাত্মবোধক কথা শুনবার পর রোশনী ও সুরোজ উৎসাহিত হয়ে ওঠে | সুরজ প্রত্যুত্তরে বলে, "এই জন্যই আমি সংগ্রামমুখর প্রতিটি পদক্ষেপে বিপদের আশঙ্কা জেনেও সৈনিকের জীবনের সাথে করমর্দন করে ভারতের প্যারামিলিটারি ফোর্সে নিজেকে সমর্পন করেছি |"


রিয়াজ : থ্যাংক ইউ মাই ডিয়ার, উইশ ইউ অল দি বেস্ট |


কয়েক মাস পেরিয়ে গেছে, রোশনী ধীরে ধীরে নিজেকে ওখানকার মতো পরিবেশে মানিয়ে নিয়ে এক সুন্দর সংসার গড়ে তুলেছে, আসে পাশের পরিবারের সঙ্গে ওর ভালোই যোগাযোগ হয়েছে | সংসারের জিনিসপত্র কিনবার জন্য মাঝে মাঝে সুরজের সাথে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বাজারে যায়, সেইসময় কিছুটা ঘোরাঘুরিও হয় | ওর এলাকাতে সপ্তাহের মধ্যে তিনবার শকুন্তলা নামে এক বৃদ্ধ মহিলা সবজি বিক্রি করতে অন্য গ্রাম থেকে আসে ; নাজিয়া ওর কাছ থেকে সবজি কেনে আর ওকে সব্জিমাসী বলে ডাকে ; যেহেতু বাজার ওদের বাসস্থান থেকে বেশ কিছুটা দূরে, তাই নাজিয়া ও রোশনী উভয়েই ওদের দৈনন্দিন প্রয়োজন অনুযায়ী ওই বৃদ্ধার কাছ থেকে


টাটকা সবজি কেনে । ধীরে ধীরে সব্জিমাসীর সাথে রোশনীর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে ; কখনও কখনও রোশনী ওর কিছু টিফিন থেকে ওকে খেতে দেয় এবং তাতে ওই বৃদ্ধা খুশি হয়ে ওকে একটু আধটু শাক-সব্জি-কাঁচা লঙ্কা ইত্যাদি বেশি করে দিয়ে যায় | বৃদ্ধার বয়স ষাটের ওপর হওয়ায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে হেঁটে কখনও কখনও ক্লান্ত হয়ে রোশনীর কাছে জল চাইলে রোশনী ওকে রুটি, মুড়ি, ভাত-তরকারি যখন যেমন থাকে তা ধরে দেয় | ওর বছর পঁচিশের সুবীর নামে এক ছেলে আছে, কিন্তু সে বিশেষ কিছু করে না বলে বুড়ির খুব দুঃখ যা মাঝে মধ্যে রোশনীকে বলে ।


একদিন রোশনী জিজ্ঞাসা করে তোমার ছেলে কি সংসারের জন্য কিছু করে না ?


শকুন্তলা : কিছু করে না তবে মাঝে মাঝে কোথায় পাহাড়া দিতে যায়, বেশিরভাগ সময়ই তো ও আমার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকে, কখনো কখনো আসে, আবার একটু আধটু নেশাও করে । কোনরখমে একটা নোংরা জামা পড়ে ঘুরে বেড়ায়, এই তো আমার সামান্য সব্জি বিক্রির কটা টাকা, এই দিয়ে খেতেই কুলায়না তো ওকে আর কি দেবো |


নরম স্বভাব ও কোমল হৃদয়ের রোশনী তাড়াতাড়ি করে সুরজের সুটকেস থেকে একটা পুরানো কিন্তু পরিষ্কার সাদা ধবধবে শার্ট খুঁজে বার করে এবং ওর ছেলের জন্য ওর হাতে ধরিয়ে দেয় | ধবধবে সাদা জামাটা ওর ছেলের জন্য উপহার পেয়ে সব্জিমাসী খুশি হয়ে রোশনীর হাত ধরে কাছে টেনে মাথার ওপর হাত রেখে আশীর্বাদ করে আর বলে, " ভগবান তোমাকে অনেক দেবে |"


সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে সুরজ বল্লো, "রোশনী, তুমি একটু চোখ বন্ধ করো, তোমার জন্য একটা গিফ্ট আছে |" রোশনী আনন্দে অধীর হয়ে তাড়াতাড়ি দু চোখ বন্ধ করে এবং উপহার পাওয়ার আশায় ওর সামনে দুহাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে,


কালবিলম্ব না করে আস্তে করে ওর কপালে একবার চুম্বন করতেই চোখ খুলে বলে উঠে, "উপহার কৈ? "


সুরজ : কেন এটা উপহার নয় বুঝি ?


রোশনী : তুমি মিথ্যাবাদী, আমাকে ঠকিয়েছো, আজকের পর থেকে কখনো বিশ্বাস করবো না...


সুরজ : শান্ত হন, শান্ত হন ম্যাডাম, একটু ধৈর্য ধরে কষ্ট করে আর একবার চোখ বন্ধ করুন |


রোশনী : আবার….., তুমি আমাকে বোকা পেয়েছো ?


সুরোজ : প্লিজ, বিশ্বাস করো, এবার তোমার হাতে পাবে গিফ্ট |


রোশনী : ওকে, প্রমিস ?


সুরজ : হ্যাঁ, প্রমিস করছি |


রোশনী : দু হাত পেতে চোখ বুজতেই , এবার হাতে চুম্বন করতেই, চিৎকার করে, "ইউ চিটার....


সুরজ : ওর হাতের ওপর একটা রঙিন প্লাস্টিকের প্যাকেট রেখে, দেখো পছন্দ হয়েছে না কি ?


রোশনী : তাড়াতাড়ি প্যাকেটটা খুলতেই ভেতরে একটা খুব সুন্দর সবুজ রঙের সাউথ ইন্ডিয়ান সিল্কের শাড়ী ; আনন্দে শাড়ীটা ধরে দুহাত দিয়ে সুরজকে জড়িয়ে ধরে, তুমি কিভাবে জানলে আমার সবুজ রঙটা বেশি প্রিয় ?


সুরজ : তোমার মনটাও তো সতেজ সবুজ , তাই ভাবলাম...


রোশনী : না না, ঠিক করে বোলো |


সুরজ : বাবা, তোমার উকিলের জেরা, ঠিক আছে বলছি, আমি যখন প্রথম তোমাদের বাড়িতে গিসলাম তোমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য, তুমি একটা সবুজ রঙের শাড়ী পড়েছিলে এবং তোমাকে তখন খুব সুন্দর দেখতে লাগছিলো, মানে এখনের মতো নয়|


রোশনী : আচ্ছা, তখন আমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিলো, মানে এখন আমি হেলাফেলা হয়ে গেছি বোঝাতে চাইছো......


সুরজ : না না..মানে আমি তা বলতে চাইনি, আসলে তখন তোমার তো বিয়ে হয়নি আর বয়সটা...


রোশনী : থাক..থাক..আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না, সত্যি কথাটা আজ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে ; তোমাদের পুরুষ জাতিটার স্বাভাবটাই হলো যতদিন না পাওয়া যায়, মেয়েটার পিছন পিছন ঘুরবে, আর যেই বিয়ে হয়ে যায় তখন অন্য মেয়েদের দিকে নজর | তখন আর নিজের বৌকে ভালো লাগে না, থাক তোমার শাড়ি তুমি রেখে দাও, আমি পড়ছি না, এবার তোমার আর একটা জুটলে তাকে পড়াবে.....


সুরজ : অরে না রে বাবা, না ..তুমি অহেতুক চিন্তা করছো, তুমি একটা ওয়ার্ড তখন আর এখন কে নিয়ে এমন ব্যাখ্যা করতে বসেছো যে আমারই মাথা ঘুরে যাচ্ছে | বলছি আমি তোমার প্রেমিক, আমি তোমার স্বামী, তোমাকে ঐরখম শাড়ি পড়ে তখন ভালো লেগেছিলো বলে এখনো ভালো লাগবে বলে এনেছি, এই কথাটা বুঝতে তোমার আর কত সময় লাগবে বোলো দেখি...


রোশনী : সত্যি বলছো ?


সুরজ : হ্যাঁ বাবা, সত্যি বলছি,মা দুর্গার দিব্ব্যি দিয়ে বলছি....


রোশনী : না এটা তোমার নয়, বেশিরভাগ পুরুষরাই নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে অন্য মেয়েদের দিকে বেশি নজর দেয় ; তাই আজ থেকে তুমি প্রমিস করো যে কোনো সুন্দরী মেয়েদের দিকে আর তাকাবে না |


সুরজ : ওরে বাব্বা, এ যে একদম ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিচ্ছ, আমি রাস্তা ঘাট চলবো কি করে ? আর সুন্দরীদের দিকে তাকাবো না তো কি করে হবে, তুমিও তো সুন্দরী ; তবে কি তোমার দিকেও তাকাবো না ?


রোশনী : একটু চিন্তা করে, না না তুমি আমার দিকে ছাড়া অন্য কারোর দিকে তাকাতে পারবে না, এটা প্রমিস করতে হবে |


সুরজ : অন্য কারোর দিকে নয়, তো রাস্তা চলতে গেলে এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে যে , এ তো মহা মুস্কিলে পড়া গেলো.....


রোশনী : ঠিক আছে একটু কনসিডার করে দিচ্ছি, তুমি কোনো সুন্দরীদের দিকে তাকাবে না |


সুরজ : বলছি ম্যাডাম, আমি না তাকালে জানবো কিভাবে, কে সুন্দরী আর কে সুন্দরী নয় ? আপনি তো ভীষণ জটিল জটিল শর্ত রাখছেন ; জানিনা সব পুরুষ মানুষকেই কি বিয়ের পরে এত শর্ত পালন করে চলতে হয় না কি ! ঠিক আছে ম্যাডাম, আপনি যখন চাইছেন আজকের পর থেকে আমি কোনো সুন্দরী মেয়েদের দিকে তাকাবো না |অবশ্য আমাকে বোলো আমি যদি কারো দিকে তাকাই, তাতে তোমার সমস্যাটা কোথায় ?


রোশনী : না ... না, আমার অনেক সমস্যা আছে ; তোমার কারো দিকে চোখ পড়লে আমার কথাটা মনে করবে, এর জন্য তোমাকে আমি আমার পাসপোর্ট সাইজ ছবিটা দিচ্ছি যা আমার কলেজের ফাইনাল পরীক্ষার আগে এডমিট কার্ডের জন্য তোলা


হয়েছিল ; তাড়াতাড়ি একটা ডায়েরির মধ্যে থেকে একটা ছোট খামে রাখা নিজের পাসপোর্ট সাইজ ছবিটা আস্তে আস্তে বের করে সুরজের হাতে দিয়ে, “যত্ন করে রেখো কিন্তু, হারাবে না বলছি ; ওই সময়কার আমার আর কোনো ফটো নেই |


সুরজ : ফটোটা হাতে নিয়ে একবার চুম্বন করে বুকের মধ্যে চেপে, “জানভী চলা যায়গা, পর তুঝে মেরা কলিজা কে বাহার কভি নেহি রাখুঞ্জী” নিজের পার্শে যত্ন করে রেখে দিয়ে বলে জীবন থাকতে সব কিছু চলে গেলেও তোমার ফটোখানাকে কখনো আমার কাছ থেকে আলাদা হতে দেব না |


রোশনী : এই তো, তুমি একজন খুব ভালো ছেলে, এখন প্রস্তুত হও, আমি তোমার ডিনারের ব্যবস্থা করছি ; তুমি জানো ... আজ আমি তোমার পছন্দমত গাজরের হালুয়া তৈরি করেছি।


সুরজ : ভালো, আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না, শিগ্রী খেয়ে শুতে যেতে হবে ।


রোশনী : না, আমি শিগ্রী ঘুমোতে যেতে চাই না, কিছু সময় তোমার সঙ্গে কথা বলি |


সুরজের খাওয়ার সময় শকুন্তলা সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে শুরু করে এবং শেষে ওর সাদা শার্টটা দিয়ে দেওয়ার ঘটনা বলতেই ..... সুরজ তৎক্ষণাৎ খাওয়অতোগুলো টি শার্ট থেকে একটা দিয়ে দিলেই চলতো | তোমার এই কাজটা মোটে ভালো হয় নি |


রোশনী : পরিবার ছেড়ে এত দূরে স্বামীর সঙ্গে থেকে হঠাৎ এইরখম তিরস্কার শুনে সেন্টিমেন্টে লাগে, কিছুটা অন্যায়ের জন্য অনুতপ্ত হয় এবং কিছুটা ভয়ে দুচোখ থেকে জল গড়িয়ে আসে, ভয়ে হাতে ধরে থাকা গাজরের হালুয়ার চামচটা কাঁপতে থাকে | সুরজ দেখতে পায় রোশনীর দুচোখ বোজা, হাতে গাজরের চামচটা নড়ছে, মাটিতে পড়ে যেতে পারে, নিজের খাওয়া ছেড়ে উঠে ওর পিছন থেকে হাতটা ধরে যাতে করে চামচটা না পড়ে যায়, আর এক হাত দিয়ে চিবুকটা আলতো করে তুলে ধরে, রোশনী করুন চোখে ওর দিকে তাকায় এবং জড়িয়ে ধরে | সুরজ মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠে, না ... না, তুমি ঠিক কাজ করেছো, আমারই ভুল হয়েছে তোমাকে ওভাবে বলা, তুমি তো একটা দরিদ্র পরিবারকে সামান্য কিছু দান করে সাহায্য করতে চেয়েছিলে মাত্র ; আমিই অন্যায় করেছি তোমার এই মহৎ কাজকে সাথ না দিয়ে নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করে | চলো একসাথে আমরা গাজরের হালুয়ার স্বাদটা তো নিই ; পুনরায় খাওয়া শুরু করে দুজনে |


রোশনী : একে অপরকে বুঝতে পারার ক্ষমতা থাকলে সংসারে কোনো অশান্তিই হয় না, আমারও ভুল হয়েছিল তোমাকে না জিজ্ঞাসা করে তোমার দরকারি জিনিস ওপর কাউকে দেওয়া |


সুরজ : এটার নামই তো জীবন, কিছু ভুল আমি করবো, কিছু ভুল তুমি করবে, কখনও তুমি মানিয়ে নেবে কখনও বা আমি | স্বদেশ সেবার থেকে বড়ো কর্তব্য পৃথিবীতে কিছু নাই এবং ভালোবাসার থেকে বড়ো ঐশর্য্য মানুষের জীবনে হতে পারে না |


খাওয়া-দাওয়া সেড়ে শুতে শুতে একটু রাত হয়ে যায়, কারেন্ট সাপ্লাই না থাকাতে রোশনীর ঘুম ভেঙে যায়, সারা দিনের ডিউটিতে ক্লান্ত হয়ে পাশে শুয়ে সুরজ অঘোরে ঘুমাচ্ছে, ও চোখ মেলে ঘরটা আর জানালা দিয়ে বাইরেটা একবার তাকায় ; চারিদিক শুধু অন্ধকার, গা টা ছমছম করে ওঠে | হঠাৎ একটা জোর বিস্ফোরণে ঘরটা কেঁপে ওঠে, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে, কাঁদতে কাঁদতে, কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে কেবল মুখ দিয়ে উঃ...উঃ...উচ্চারণ করে সুরজকে জড়িয়ে ধরে | আওয়াজে সুরোজ উঠে বসলে, ও বলে থান্ডারিং........ থান্ডার .., সুরজ ওর মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে রেখে বালিশের পাস্ থেকে টর্চটা নিয়ে একবার জ্বালিয়ে দ্যাখে ঘড়িতে তখন রাত দুটো বাজে | মৃদু স্বরে বলে এটা থান্ডারিং নয়, IED বা Improvised Explosive Device blast এর আওয়াজ, কালকে হয়তো টিভিতে দেখতে পাবে হতাহতের সংখ্যা | তুমি ভয় পেয়োনা, আমি তো তোমার সাথে আছি; আর তুমি তো সন্ত্রাসবাদীদের উপদ্রুত এলাকাতে বাস করছো যেখানে বোমা বিস্ফোরণ একটা তুচ্ছ ব্যাপার | এখন বেশি চিন্তা করো না, আমি কয়েক সপ্তাহ পরে ছুটি নিয়ে বাড়ি যাবো, তখন তোমাকে আমার বাড়িতে রেখে আসবো । তুমি ওখানে থেকে চাকরি পাওয়ার জন্য চেষ্টা করবে |


রোশনী : তখনো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে, ছিঃ, লজ্জা করে না বলতে, বিয়ের পরে স্বামীর ঘরই স্ত্রীর কাছে স্বর্গ | তুমি যখন যেখানে যেভাবে আমাকে রাখবে আমি সেইভাবেই মানিয়ে নেবো, দেখো আমার কোনো অসুবিধা হবে না | দেশের জন্য এই ত্যাগটা কি তোমার একার, তোমাকে সাথ দেয়াও তো আমার কর্তব্য যাতে তুমি এগিয়ে যেতে পারো | মানুষের ভয়ই সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা ; দুর্বল চিত্ত, ভীতু এবং কাপুরুষেরা কখনো জীবনে কোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে না, এমনকি ভয়কে কখনও জয় করতে পারে না | আমি তা নই, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তোমার পাশে থাকবো, একটা একুরিয়ামের মাছেজীবন নয় যে জীবনে ভয় ও দুর্বলতাকে পদাঘাত করে নায়কের মতো সমস্ত যুদ্ধ জয় না করা যায় ।


সুরজ : বাঃ, খুব ভালো কথা বলেছো, আমাকে তো তুমি অনেক বেশি boost up করলে, তবে তুমি এত ভয় পেলে কেন ?


রোশনী : একটু লজ্জিত হয়ে, না..মানে এটা তো প্রথম তাই, দেখো, আজকের পর থেকে আর কখনো আমি ভয় পাবো না |


রোশনীর বাম হাতটা সুরজ ডান হাত দিয়ে ধরে নিজের বুকের মধ্যে রেখে পাশাপাশি শুয়ে, ঠিক সেই সময় আকাশের মেঘ সড়ে যাওয়াতে কিছুক্ষন আগের অন্ধকার দূর করে পূর্ণিমার চাঁদের আলো জানালা দিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে, সেই রশ্মিচ্ছটায় একে ওপরের মুখমন্ডল দেখতে থাকে ; রোশনীর মৃদু হাসি দেখে সুরজ বলে ওঠে, "আমার তো মনে হচ্ছে চাঁদের আলোর বা হাসির থেকে তোমার শুভ্রতা ও হাসি বেশি উজ্জ্বল ও সুন্দর |"


রোশনী : সেটা কেন বলতো দেখি ?


সুরজ : কেন আবার, সত্যই তুমি সুন্দর |


রোশনী : না, জবাবটা ঠিক হলো না , আমি বলছি, "তোমার পাশে আছি বলে |"


সুরজ : সত্যই তুমি আমার পাশে আছো বলে খুশি এবং সুখী ?


রোশনী : তাতে তোমার কি এখনো কোনো সন্দেহ আছে ?


সুরজ : না, আজ থেকে আমার আর কোনো সন্দেহ নেই, চলো আমরা এই পূর্ণিমার রাতে আমাদের ঘরের উঠোনটায় দাঁড়িয়ে আমাদের চারিপাশের প্রাকৃতিক শোভা দেখি |


রোশনীর হাত ধরে দরজা খুলে ঘরের বাইরের উঠোনটায় দাঁড়ায়, আমি মনে করি আমি এখন একা নই; তুমি আমার জীবনে সবসময় আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছো বা থাকবে যাতে আমি যুদ্ধে এভারেস্ট জয় করতে সক্ষম হই বা সফলতার আকাশকে স্পর্শ করতে পারি, এখন থেকে তুমি আমার যুদ্ধের মানসিক শক্তি ও বুলেট ।"


রোশনী : চাঁদটা কতো সুন্দর দেখাচ্ছে, ওই চন্দ্রের বিন্দু বিন্দু আলো ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পৃথিবীতে যাতে আমরা সবাই সমানভাবে গ্রহণ করতে পারি , পাহাড়গুলো দেখো ওদের প্রয়োজনমতো আলো গ্রহণ করে গাছগুলোকে রাত্রে কত সুন্দরভাবে শান্তিতে রেখেছে, দেখো দেখো পাহাড়গুলো কত সুন্দর লাগছে, চাঁদের নিচে পৃথিবী এত সুন্দর ও নীরব, চারিদিকে যেন আলোর বন্যা বইছে | আচ্ছা বলতে পারো এত সুন্দর পৃথিবীতে সন্ত্রাসবাদীরা কেন রক্ত দেওয়া-নেওয়ার খেলায় মেতে উঠে ?


সুরজ : ওরা ভালোবাসতে জানে না বোলে, আমার ভারতমাতাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য আমি হাজারটা আতঙ্কবাদীকে নিমেষে গুলি করতে পিছপা হবো না কারণ আমি দেশের প্রহরী, অথচ ঈশ্বরের কাছে প্রাথনা করি যাতে একটি পিপীলিকাও আমার পদপৃষ্ট হয়ে মারা না যায় | আমি গভীর ঘুমের মধ্যেও অসহায় এবং নির্দোষ মানুষদের কান্না শুনতে পাই ; যাতে তারা নির্ভয়ে এবং শান্তিতে ঘুমাতে পারে তাই আমরা সৈনিকরা সজাগ থাকি । আমরা সমাজ বা দেশকে গড়তে বা অক্ষুন্ন রাখতে চাই, আর আতঙ্কবাদীরা চায় দেশ বা সমাজকে ধ্বংস করতে |


সুরজ দ্রুত কুটিরের ভিতরে যায় এবং দুটো অগ্নেয়াস্ত্র দুহাতে নিয়ে ফিরে আসে ; রোশনীকে দেখিয়ে বলে এটা এস এল আর AK-47 আর এটা হলো 9 এমএম পিস্তল। পিস্তলখানা হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত অস্ত্র যা আমি সবসময় আমার সাথে সাথে রাখি অন্যটা AK-47 যা লড়াইয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় । আমি এই অস্ত্রের


প্রশিক্ষণ খুব ধৈর্য ও আন্তরিকতার সাথে শিখেছি, তাই আমার নিশানা খুব একটা মিস হয় না | রোশনী আগ্রহান্বিত হয়ে চট করে 9 এম এম পিস্তলখানা টেনে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে নেয়, বিদ্যুতের গতিতে সুরজ ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বলে উঠে, "এগুলো খেলনা পিস্তল নয় যে তুমি যে ভাবে ইচ্ছা নাড়াচাড়া করবে | এখুনি একটা fire হলে চারিদিক থেকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যাবে ; সবাই ভাববে রাত্রে আতঙ্কবাদীরা হানা দিয়ে ফায়ার করছে |I’ll give you proper training at right time. বেশ কিছু সপ্তাহ পরে রোশনী 9 এম এম পিস্তলকে কোনও প্রশিক্ষিত সৈনিকের মত ব্যবহার করতে শিখে যায় |


কয়েক মাস পরে হঠাৎ একদিন সুরজ এসে জানায়, "রোশনী, আমাকে একটি বিশেষ অপারেশনের জন্য এখন থেকে বেশ কিছু দূরে যেতে হবে এবং ঘরের বাইরে তিন দিন কাটাতে হবে। আমার ফিরে না আসা পর্যন্ত তোমাকে এই 72 ঘন্টা একা থাকতে হবে। রিয়াজ দাদা এবং নাজিয়া বৌদি প্রয়োজনমতো তোমায় সহায়তা করবে। যদি আমার ফিরতে দেরিও হয়, তুমি চিন্তা করো না সময়মত আমার কোম্পানির সহকর্মীরা ঘরের প্রয়োজনীয় রেশন, শাক- সবজি বা মুদিখানার যাবতীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করবে | ওরা অনেকে আমাকে কি বলে জানো,"আপনার স্ত্রী সাক্ষাৎ মা ভবানী এবং এক আদর্শ সতী-সাদ্ধী স্ত্রী, নতুবা এরূপ জায়গাতে থাকা সকলের পক্ষে সম্ভব নয় । তুমি বিচলিত হয়ো না, আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।


রোশনী : আমি তোমাকে মিস করবো কিন্তু চিন্তা করো না, তিনটে দিন ঠিক কেটে যাবে |


সুরজ : যাবার জন্য নিজের পিস্তলটা ছাড়া সার্ভিসের এস.এল.আর., কিছু ড্রাই ফ্রুট, জলের বোতল, বাইনোকুলার ইত্যাদি সমস্ত ব্যাগের মধ্যে গোছাতে থাকে |


রোশনী এক মিনিটও সময় নষ্ট না করে রান্নাঘরে ঢুকে যায়, কিছুক্ষন পরে বেশি করে লুচি ও আলু ভাজা একটা প্যাকেটে ভোড়ে তাড়াতাড়ি নিয়ে এসে হাজির হয়ে বলে খাবার প্রস্তুত ; আগামীকাল সকালের জন্য তোমার টিফিন, সময়মতো খেও এবং জলপান করো | নিজের শরীরের দিকে লক্ষ্য রাখবে |


সুরজ : ও হো, তুমি টিফিন বানিয়ে নিয়ে এসেছো, অবশ্যই খাবো, এটা তো অমৃত, দাও দাও, ওর হাত থেকে নিয়ে জ্যাকেটের বড়ো পকেটে রাখে |


একটু পরেই বাইরে গাড়ির হর্ন বেজে ওঠে, রোশনী ঘর থেকে বেরিয়ে দ্যাখে চার-পাঁচজন সিপাহী যুদ্ধের বেশে হাতে SLR নিয়ে একটা জীপ থেকে নেমে এগিয়ে আসছে, ওকে দেখেই “নমস্তে ম্যাডাম” বলে সম্বোধন করে | সুরজ কাল বিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি একবার দেয়ালে টাঙানো মা কালীর ফটোর দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে প্রণাম করে, রোশনী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলে ওর কপালে দুবার চুম্বন করে হেসে বলে, "এখন আসছি, ভালো থেকো |"


রোশনী : আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো, তাড়াতাড়ি চলে এসো |


গাড়ির মধ্যে বসে সুরজ হাত নাড়িয়ে বাই বাই জানালে রোশনী বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে হাত হেলিয়ে প্রতিত্তর জানায়, ধীরে ধীরে অন্ধকারে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গাড়িখানা অদৃশ্য হয়ে যায় | আঙিনাতে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে আকাশ, দূরের পাহাড়গুলো, নক্ষত্র এবং চাঁদ দেখতে দেখতে মনটা উদাস হয়ে যায়, ঘন জঙ্গলের দিকে একবার দৃষ্টিনিক্ষেপ করতে নিজুম সন্ধ্যায় নিজেকে একটু একাকী এবং অসহায় অনুভব করে ভয় পায়, তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দ্যাখে যাবার সময় সুরজ ভুল করে ওর কলমটা টেবিলে ফেলে গেছে | হাতে করে তুলে একবার ভালো করে দেখে দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারখানা, তাড়াতাড়ি আগের


তিনটে দিনের তারিখে গোল গোল করে দাগ টেনে ভাবে আজ চব্বিশ তারিখে গেছে মানে আঠাশ তারিখে ফিরে আসবে |


পরের দিন শকুন্তলা এসে বেশ কিছু তাজা শাক সবজি দেয়, কিন্তু মূল্য নিতে অস্বীকার করে কারণ ওগুলো ও ঘরের খাবারের জন্য তৈরি করেছিল, বিক্রির জন্য নয়, তাই ওর নিজের খাবারের জন্য কিছু রেখে বাকি ওকে খেতে দেয় আর বলে তুই তো আমার বেটি, তোকে দেবো না তো কাকে দেবো | আমি ওই পাশের গ্রাম লক্ষ্মীপুরে থাকি, আমার বাড়ির একটু দূরে জমি আছে, সেখানে সবজি চাষ করি, তুই একদিন আমার বাড়ি আয়, তোকে সব ঘুরে ঘুরে দেখাবো |


সকাল সকাল সব রান্না-বান্না শেষ করে রোশনী ভাবে আর একটু পরে সন্ধ্যার সময় ও চলে আসবে, খুশি হয়ে ওর দেওয়া সবুজ শাড়িটা পড়ে পায়ে আলতা দিয়ে নেয়; হঠাৎ শরীরটা একটু খারাপ বোধ হয়, বমির বেগ আসে আর অস্থির অস্থির করে | একটু পরে নাজিয়া এলে ওকে সব জানায়, ও আনন্দ করে বলে ওঠে, " আনন্দের সংবাদ, তোমার ঘর আলো করে সন্তান আসছে |" রোশনী লজ্জা পেলে নাজিয়া বোঝাতে থাকে এটা শুভ সংবাদ, তোমার স্বামী এলে মিষ্টি খাওয়াতে হবে |


আস্তে আস্তে বেলা পেরিয়ে দিন শেষ হয়ে যায়, চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসে, হন্তদন্ত হয়ে কোনো গাড়ির আওয়াজ শুনলে তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে দাঁড়িয়ে চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, কখনো আবার জানালার পর্দা তুলে দূরে পাহাড়ের ছোট ছোট আলোর রশ্মিগুলো ভালো করে দেখতে থাকে কোনো গাড়ির আলো ওর ঘরের দিকে আসছে কি না ! যখন কোনো গাড়ির আলো আস্তে আস্তে দূরের ঘন জঙ্গলে মিলিয়ে যায়, হতাশ হয়ে ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে | ধীরে ধীরে ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘরে গেলে এক অজানিত আশংকা বুকে বাসা বাঁধে, অকস্মাৎ লোডশেডিং হয়ে চিরিদিকটা অন্ধকার


হয়ে আসে ; তৎক্ষণাৎ একটা গাড়ির হর্ন শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি ইমার্জেন্সি লাইটটা জ্বেলে দরজা খুলে আঙিনায় দাঁড়ায়, পুলিশ বাহিনীর একটা মিনি ট্রাক কিছু সৈন্যদের নিয়ে প্রাঙ্গণে আসে। তিনজন কমান্ডো মিনি ট্রাক থেকে নিঃশব্দে নিচে নামলে কমান্ডিং অফিসার মিস্টার জোসেফ যিনি ড্রাইভারের পাশে বসেছিলেন ধীরে ধীরে নিচে নেমে এসে সৈন্যদের ফিসফিস করে কিছু বলতে থাকে | চারিদিকে একটা থমথমে ভাব লক্ষ্য করে রোশনীর উদ্বেগ বেড়ে যায়, মিনি ট্রাকের ডিম লাইটে রোশনী স্পষ্ট করে কিছু দেখতে না পায়ে ইমার্জেন্সি লাইট হাতে করে এক পা দু পা করে এগুতে থাকে |তিনজন কমান্ডো মিলে সাদা কাপড়ে মোড়া সুরজের মৃতদেহ ধরে ধীরে ধীরে ট্রাক থেকে নিচে নেমে আঙ্গিনাতে নামিয়ে রাখে । রোহিণী নিস্তব্দ হয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে, হাতে ধরে থাকা ইমার্জেন্সি লাইটটা মাটিতে পড়ে একবার দ্বপ করে জ্বলেই বাল্বটা ফিউজ হয়ে নিভে যায় | সবাই দেখে একটা পাথরের মূর্তির মতো রোশনী নতুন সবুজ শাড়ি পড়ে সাজগোজ অবস্থায় দাঁড়িয়ে | নাজিয়া দৌড়ে এসে সুরজের মৃতদেহ দেখে হাঁউমাঁউ স্বরে চিৎকার করে কেঁদে রোশনীকে দুহাতে ধরে পাশে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসাতে গিয়ে ব্যর্থ হয় ; ও একটা পাথরের মূর্তি এবং ওর মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়াই হচ্ছে না |নিকটবর্তী এলাকার কিছু মহিলারা যারা সুরজের পরিচিত ছিলো ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে ; ওদের মধ্যে একজন প্রৌঢ়া মহিলা বলে উঠেন, "বেশিক্ষন ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ওর হার্ট এট্যাক হয়ে যাবে | ওর শরীরে একটু জলের ঝাপ্টা দাও , তাতে ওর জ্ঞান ফিরে আসবে | তাড়াতাড়ি একজন সৈনিক একটা বালতি করে জল আনলে এক ভদ্রমহিলা রোশনীর চোখে মুখে বারবার ঝাপ্টা দিতে শুরু করে |কিছুক্ষন পড়ে অত্যন্ত্য বিষণ্নতার সাথে একবার চারিপাশ তাকিয়ে লাশের উপর পড়ে অজ্ঞান হকিছু পরে রোশনী ওর চোখ খুলে তাকায় সুরজের মৃত শরীরের দিকে, একজন সৈন্য মৃত শরীরের ওপর থেকে ধীরে ধীরে সাদা কাপড়টা তুলে নেয় | জোসেফ মৃতদেহের জ্যাকেট অনুসন্ধান করে সুরজের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বের করে রোশনীর হাতে তুলে দিতে ইশারা করেন | একজন কমান্ডো এগিয়ে এসে রক্তে ভেজা জ্যাকেটের বোতাম খুল্লে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট হাতে লাগে, রোশনী তাড়াতাড়ি প্যাকেটটা টেনে নিয়ে দেখে, প্যাকেটের মধ্যে তখনো দেড় খানা লুচি আর সামান্য একটু আলু ভাজা অবশিষ্ট রয়েছে, জ্যাকেটের অন্য একটা পকেট থেকে একটা মানি পার্স পাওয়া যায় যার মধ্যে যত্ন করে রাখা ছিলো কিছু টাকা আর একটা ছোট খাম, রোশনী খামটা ধীরে ধীরে খুলে দেখতে পায়, সুরজকে দেওয়া ওর পাসপোর্ট সাইজের ফটোখানা | মনে পড়ে যায় কিছুদিন আগে সুরজকে দেওয়া ফটোখানার বিনিময়ে ওর প্রতিশ্রুতির কথাগুলো, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুঃখে ও শোকে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, "এই তো আমার ফটো, তোমাকে দেখতে বলেছিলাম, দ্যাখো, দ্যাখো, কেন দেখছো না ? তোমায় না বলেছিলাম কোনো সুন্দরী মেয়ের দিকে তাকাবে না, আমি বলছি তাকাও, তাকাও, সবার দিকে তাকাও, আমি তোমায় বাধা দেবো না, তুমি সবার দিকে তাকাও, তুমি না বলেছিলে ওয়াটার-ফল মানে পানির-পতন ; আমি আর পানির-পতন দেখতে যাবো না, তুমি ফিরে এসো, তুমি একবার ফিরে এসো | আমি এখানে একা, তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই, আমি কিভাবে বাঁচব ? কমান্ডিং অফিসার জোসেফের বয়স প্রায় পঞ্চাশ বছর, এগিয়ে এসে রোশনীর মাথার ওপর আলতো করে হাত রেখে বলে ওঠে, " ম্যাডাম, দুঃখ আপনার একার নয়, আমার টিমের বেস্ট কমান্ডো ছিলো সুরজ, ওকে হারিয়ে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হলো,না, গতকাল পর্যন্ত অপারেশনে ও একাই পাঁচজন আতঙ্কবাদীকে শেষ করেছিলো ; এনকাউন্টার শেষ করে ও যখন ফিরছিলো, ওর সাথে অন্যের ডিস্টেন্সটা অনেকটা বেড়ে যায়, হঠাৎ কোনো একজন যে জানতো ওই রাস্তা দিয়ে সুরোজ আসবে, সেখানে লুকিয়ে বসে ওকে পিছন থেকে গুলি করে, যার জন্য ও কোনো সুযোগ পায়নি ডিফেন্স করবার | আমরা চারিদিক কর্ডন করে, সার্চ চালিয়ে যাচ্ছি যত তাড়াতাড়ি আতঙ্কবাদীকে ধরা যায় | ওর কণ্ঠস্বর আজও আমার হৃদয়ে গাঁথা হয়ে আছে, ও বলতো, "আমরা যুদ্ধ জয় কোরবো কারণ আমরা আতঙ্কবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি যারা ভারতমাতার শত্রু | আমরা মাতৃভূমির জন্য বলিপ্রদত্ত, আমি যখনি মারা যাই না কেনো, কিছু লোক এসে তাদের দুঃখ প্রকাশ করবে, কিন্তু কয়েক ঘণ্টার পরই তারা তাদের বাড়িতে ফিরে যাবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার মৃতদেহকে সৎকার করে ; আমার মৃতদেহ তাদের কাছে হবে অস্পৃশ্য, কিন্তু কেবল মাতৃভূমিই একমাত্র যে তাঁর কোলে স্থান দিতে দ্বিধা করবে না এবং যেখানে আমি শান্তিতে শুয়ে থাকবো |"


অনেকটা সময় পর রোশনী কিছুটা শক্ত হয়ে উঠে বসে, নিকটবর্তী মহিলারা অনেক করে বুঝিয়ে সান্তনা দিতে থাকে, মিস্টার জোসেফ জানায় ওর পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব এখন থেকে ওদের, নিজেকে শক্ত করে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে হবে | আস্তে আস্তে রোশনী উঠে দাঁড়িয়ে চুলগুলো শক্ত করে মাথায় জড়িয়ে নিয়ে বলে "হ্যাঁ, যেভাবেই হোক আততায়ীকে ধরা চাই, আমি ওর রক্ত দেখতে চাই, আমার সবকিছু উজাড় করে নিয়েছে, সে যেন পালাতে না পারে |


জোসেফ : আমরা চারিদিকে ফাঁদ পেতে রেখেছি, সে কোনোভাবে পালাতে পারবে না, নিশ্চয় নিকটবর্তী এলাকাতে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছে |


আশা করি তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে হদিস পেয়ে গ্রেফতার করতে সক্ষম হবো ; আমাদের সান্ত্রীরা এখন থেকে সব সময়ে এখানে পাহারা দেবে |


রোশনী : না, তার আর কোনো প্রয়োজন নেই, আমি জানি ও আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না, ও ঠিক আসবে আর আমার পাশে পাশে থাকবে....বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে |


জোসেফ : আমাদের নিয়ম অনুযায়ী যদি আপনি রাজি থাকেন, তবে সুরজের মৃত শরীরকে বায়ুযানে আপনার সাথে আপনার দেশের বাড়িতে সসম্মানে পৌঁছে অন্তিম সৎকারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে |


রোশনী : না, আমার স্বামীর কাতিল যতদিন না ধরা পড়ছে, আমি এখান থেকে কোথাও যাবো না ; ওর যা কিছু করণীয় তা সব এখানেই হবে পুরো মিলিটারির নিয়ম অনুযায়ী |


আস্তে আস্তে কয়েকজন কমান্ডো মৃতদেহকে ফুল ও মালা দিয়ে সাজিয়ে ওর সামনে শোকশস্ত্র করে সম্মান প্রদর্শন করে ট্রাকে তুলে নিয়ে যায় | আসে পাশের সমস্ত লোকজন চিৎকার করে বলে ওঠে, "হামারা সুরজ, অমর রহে |" ধীরে ধীরে মিনি ট্রাকটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেলে রোশনী ডুকরে কেঁদে ওঠে |


ঘরের মধ্যে ঢুকে অঝোর ঝরে কাঁদতে থাকে, নাজিয়া ও রিয়াজ এসে অনেক অনুরোধ করে আজকের রাতটা অন্তত ওদের ঘরে থাকতে ; ও কোনো কোথায় কান দেয় না, শুধু আপন মনে বলতে থাকে তুমি আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেলে ? আবার একটু পরেই বলে যেভাবেই


হোক আমার তোমার কাতিলের রক্ত চাই, আমি ওকে ছাড়বো না | একসময় অবসন্ন হয়ে একটু ঝিমুনি ভাব আসাতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে | হঠাৎ সোঁ সোঁ শব্দে জোর জোর হওয়া বইতে শুরু হাওয়ায় জানালার পাল্লাগুলো একবার বন্ধ হয়ে খুলে যায় ; রোশনী লুটিয়ে মেঝেতে পড়েছিল, ঝড়ের সোঁ সোঁ শব্দে ধড়পড় করে উঠতেই জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকায় | মেঘে প্রায় নব্বই শতাংশ চাঁদটা ঢাকা পড়ে গেছে, মেঘের পাশ দিয়ে শুরু একফালি চাঁদের আলোর রশ্নি বারান্দার দেয়ালে পড়ছে, মাঝে মাঝে দূরের গাছের ডালপালাগুলো হওয়াতে নাড়াচাড়া করায় মনে হয় দেয়ালে ছায়ার মতো কি যেন একটা চলাফেরা করছে, সাথে সাথে কানে আওয়াজ আসে কে যেন সৈনিকের বুট পড়ে আস্তে আস্তে বারান্দায় পায়চারি করছে | ভয়ে রোশনীর শরীরের সমস্ত রোমকূপ খাঁড়া হয়ে উঠে, বুক ধড়পড় করতে থাকে ; বুটের আওয়াজ ক্রমাগত জোরে জোরে হতে থাকে | শরীরের রক্ত হীম হয়ে আসে, বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে, বুটের শব্দটা আস্তে আস্তে ঘরের মেঝেতে প্রবেশ করে, সাথে হওয়ার বেগটাও বেশ বেড়ে ওঠে | মনে হতে থাকে শাঁস বুঝি বন্দ হয়ে যাবে ; এটা কি সপ্ন না সত্যি বোধগম্ম্য হয় না | লক্ষ্য পড়ে দেয়ালে হ্যাঙ্গারে টাঙানো সুরজের উর্দিটা বারংবার হাওয়াতে নড়ছে, অপলকভাবে কিছক্ষন উর্দিটার দিকে তাকাতে চোখে পড়ে ডানদিকের হাতাটা ক্রমাগত বামদিকে সড়ে এসে কি যেন ইশারা করে যাচ্ছে ; অথচ বাম দিকের হাতাটার কোনোরখোম মুভমেন্ট হচ্ছে না | ইউনিফর্মের একটা দিক নড়লেও ওপর দিকটা কেনো নড়ছে না ভেবে পায় না | তবে কি বাম দিকে কোনো অশুভ সংকেত হানা দিচ্ছে ! না....না...আর দেরি নয়, কোথায় সুরজের পিস্তলখানা ! কোথায় পিস্তলটা.....টেবিলের ওপর যেন একটা খড় খড় শব্দ কানে আসে,


তাকিয়ে দেখে কালো রঙের চকচক করছে সুরজের 9 mm পিস্তলটা টেবিলে রাখা | চকিতে উঠেই পিস্তলটা হাতে তুলে ম্যাগাজিনটা খুলে বের করে দেখে তাজা পাঁচটা বুলেট | দু হাতে শক্ত করে ধরে বলে ওঠে কে ওখানে ? কে বলো, নতুবা এক্ষুনি গুলি করবো | নিশুতি গভীর রাত, চারিদিক থমথমে ; ইউনিফর্মটা হ্যাঙ্গার থেকে খুলে একবার হাতে করে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে |


অনেক রাত হয়েছে, ছেলে ফিরছে না বলে ব্যাকুল হয়ে শকুন্তলা একবার ঘরে আর বাইরে হ্যারিকেন নিয়ে আনাগোনা করছে | বয়সের ভারে চোখেও ভালো দেখতে পায় না ; কিছুক্ষনের মধ্যে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে অধীর হয়ে দরজা খুলেই দেখে সুবীর | অনেক প্রতীক্ষার পর ছেলে আসাতে আনন্দে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে, সাথে সাথে অনুভব হয় ওর সারা শরীরে কি যেন চটচটে লেগে আছে | তাড়াতাড়ি আলোখানা ওর মুখের কাছে আনতেই ভয়ে বুকটা শুকিয়ে ওঠে | রোশনীর দেওয়া সাদা জামাটা গোটাটাই রক্তে ভিজে লাল হয়ে আছে ; ভয়ে আঁতকে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করে, "এত রক্ত কোথা থেকে এলো ?"


সুবীর : একটু হেসে নিয়ে, আরে না মা না, এটা রক্ত নয়, এটা আমার রক্ততিলক ; এটার জন্য কতদিন অপেক্ষা করেছি তুমি জানো মা ! দীর্ঘ পাঁচটা বছর ধরে আমি চৌকিদার হয়ে আমাদের সিকিউরিটি বিভাগে কাজ করে এসেছি | মাইনে তো কিছু দিতো না, সামান্য হাত খরচ যা পেতাম, তা তো আমার মদ গিলতেই শেষ হয়ে যেতো |কতদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম এই সুযোগটার জন্য, শেষে তুমি আমাকে সব বলে দিয়ে আমার চলার রাস্তাটা একদম পরিষ্কার করে দিলে | আজ আমি কেল্লা ফতে করে দিয়েছি একজন বড়ো কমান্ডোকে খতম করে | সঙ্গে সঙ্গে আমাকে


আমাদের চিফ জানিয়ে দিয়েছে যে আজ থেকে আমি আর চৌকিদার নই, আমি হচ্ছি এরিয়া কমান্ডার | আমার অধীনে এখন থেকে অনেক চৌকিদার আর কমান্ডার কাজ করবে | ওই যে পুলিশে যারা কাজ করে আর বড়ো বড়ো নেতাগুলো বা রাষ্ট্রবাদী যারা আমাদেরকে বলে সন্ত্রাসবাদী……এক ঢোক মুখে দিয়ে, আমরা সন্ত্রাসবাদী হতে যাবো কেনে ? আমরা আসলে আমাদের রাস্তা পরিষ্কার করি, রাস্তা মানে যারা আমাদের বাধা দেবে তাদেরকে সাফ করতে হবে ; তাই আমরা হলাম গিয়ে প্রতিবাদী, সন্ত্রাসবাদী নোই | আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করি শুধু, তুমি কিন্তু কখনো কাউকে বোলো না আমি সন্ত্রাসবাদী, বলবে আমি হলাম গিয়ে প্রতিবাদী | আবার মদ খেতে খেতে……আমি প্রতিবাদী, প্রতিবাদী...হি...হি...হি..প্রতিবাদীই……সত্যবাদী..., যা..যা...মা তাড়াতাড়ি খেতে দে | ও যা, আমি তো ভুলেই গেছি এত বড়ো খুশির সংবাদ, তাই তোমার জন্য এনেছি এই দেখো....এই দেখো...একটা কাগজের মোড়কের ভেতর থেকে বের করে একটা চিকেন তন্দুরি, তুমি এতবড়ো সাহায্য করেছো তাই তোমার জন্য এটা এনেছি……খাও ; এখন আমি আরও বেশি অর্থ উপার্জন করবো এবং অনেক কমান্ডার আমাকে সাহায্য করবে । ওই যে সেদিন তুমি বললে সুরজ….একজন পুলিশ অফিসার বিশেষ অপারেশনে যাচ্ছে, ব্যাস তখন থেকেই আমি ওকে হত্যা করবার জন্য উঠে পরে লাগি, পিছন থেকে আক্রমণ করার জন্য একটা গোপন ফন্দি এঁটেছিলাম । সন্ধ্যাবেলা যখন আমাদের পাঁচজন কমান্ডারকে হত্যা করে ও ফিরে আসছিলো তখন আমি কেবলমাত্র দুটো গুলি একদম পিছন থেকে মাথার খোপড়িতে মারি, ও সাথে সাথে সামনের দিকে না পড়ে পিছন দিকে আমার কাঁধে উল্টে পড়ে ; তাই তো আমার গোটা জামাটা


রক্তে ভিজে গেলো, এটা রক্ত নয়, এটা প্রমোশন, এটা আমার উন্নতি ; আমি ওমনি তাড়াতাড়ি ওর অস্ত্রটা জঙ্গলে একটা গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে রাখি, আর আমাদের চিফকে খবর দিই । শুনে এত খুশি হলো তোমাকে বোঝাতে পার্বোনি মা | দাঁড়াও, দাঁড়াও....আমি খাবার আগে আমার এই সুন্দর বন্ধু বন্দুকটা ওই কাঠের বাক্সে লুকিয়ে রাখি, তুমি খাবারটা রাখো ততক্ষন | সুবীর কাঠের বাক্সটা খুলে একটা ন্যাকড়া জড়িয়ে ওর লোকাল মেড ছোটো বন্দুকটা ঢুকিয়ে রাখে |


শকুন্তলা নিস্তব্দে থালাতে ভাত, তরকারি সাজিয়ে খেতে দিলে সুবীর যখন নেশার ঘোরে খেতে থাকে, আস্তে আস্তে কাঠের বাক্সের দিকে এগিয়ে গিয়ে চুপি চুপি বাক্সটা খুলে অগ্নেয়াস্ত্রটা বের করে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে ওঠে, "তুই আমার মেয়ের জীবন শেষ করে দিয়েছিস, তুই শয়তান, তুই আমার ছেলে নয়, ঘাতক, অপরাধী, আমার মেয়ে রোশনীকে বিধবা করে দিয়েছিস, তোর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই, আজ আমিই তোকে শেষ করবো.....বারবার বন্ধুকটা নাড়াচাড়া করে গুলি করবার চেষ্টা করে কিন্তু চালাতে সক্ষম হয় না | সুবীর খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে ওর মা হাতিয়ারটা ধরে রাগে কাঁপছে |


সুবীর : মা, মা..ওটা মাটিতে ফেলে দাও, এ তুমি কি করছো...


শকুন্তলা : না...না...আমি তোকে ক্ষমা করবো না, আমি সবাইকে জানিয়ে দেব আমার ছেলে কাতিল ; চিৎকার করে ওঠে.....শুনছো শুনছো, আমার সুবীর খুনি, ও একটু আগেই একজনকে খুন করে এসেছে ; ওকে এখুনি পুলিশে দাও |


কাঁপা কাঁপা হাতে বারবার চেষ্টা করে ট্রিগারটা টিপে ফায়ার করতে, কিন্তু অসফল হয় ; কালবিলম্ব না করে সুবীর দূরে দাঁড়িয়ে বাম পাটা তুলে সজোরে মায়ের কোমরে এক লাথি মারে, সাথে সাথে আগ্নেয়াস্ত্রটা ছিটকে দূরে পড়ে এবং শকুন্তলা শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে ; দ্রুত মাটি থেকে হাথিয়ারটা তুলে নিয়ে শক্ত করে মায়ের দিকে ধরে বলে ওঠে, "তুমিই আমার প্রকৃত শত্রু, আমার উন্নতিতে তুমি খুশি না হয়ে সকলকে ঢেরা পিটিয়ে কাল বলে বেড়াবে যে তোমার ছেলে একজন খুনি, ওকে ধরে পুলিশে দাও ; সে সুযোগ তুমি আর পাবে না মা....হাতিয়ার থেকে পর পর দুটো বুলেট সশব্দে নির্গত হয়ে শকুন্তলার বাম দিকের বক্ষ ঝাঁজরা করে দেয়, পুরো মেঝেটা রক্তে লাল হয়ে যায় |


তাড়াতাড়ি করে ম্যাগাজিনটা খুলে দেখে একটা বুলেট তখনও বেঁচে আছে ; মনে মনে বিড়বিড় করে, কাল চিফকে গুলির হিসাব দিতে হবে,"দুটো দিয়ে ওই কমান্ডোটাকে খতম করেছি, আর দুটো দিয়ে মা টাকে শেষ করে দিলাম, এই একটা বুলেটকে যত্ন করে রাখি কখন আবার কি কাজে লাগে !" অতি সত্তর ম্যাগাজিনটা বন্দুকের মধ্যে ভোড়ে কোমরে গুঁজে রেখে মায়ের লাশটা সরাতে গেলে কোনো এক নারীর কণ্ঠস্বর কানে আসে ; তাড়াতাড়ি মায়ের লাশটা ছেড়ে দিয়ে কোমর থেকে বন্দুকটা টেনে বের করতে গেলে, নারীর গম্ভীর কণ্ঠস্বর কানে আসে "হাত ওপর |" সামনে তাকিয়ে দেখে.......ঘরের খোলা দরজার সামনে 9 মিমি পিস্তল হাতে ওর মুখের সোজাসুজি নিশানা করে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক নারী, চুলগুলো ইতস্তত বিক্ষিফ্ত হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, চোখদুটো যেনো রাগে বড়োবড়ো লাল হয়ে আছে ; পরিধানে কমান্ডোদের ডিপ সবুজ রঙের ইউনিফর্ম ; হাতে ধরা পিস্তলের নলটা সোজা ওর মুখের দিকে নিশানা


নেওয়া, গর্জে বলে ওঠে, “একটু নড়লেই সব কোটি গুলি মাথাকে টুকরো টুকরো করে দেবে |”


সুবীর : ভয় পেয়ে আমতা আমতা করে কে...কে....তুমি ? তুমি তো আমাদের লিবারেশন ফোর্সের কেউ নও, তবে কোন দলের সদস্য ? চাইলে তুমি এক্ষুনি আমাদের লিবারেশন ফোর্সে যোগ দিতে পারো ; তোমাকে দেখে যা মনে হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে তুমি অনেক বড়ো নেত্রী হয়ে অপারেশন পরিচালনা করতে পারবে | এই জন্য তোমাকে সব রখম সুযোগ দেওয়া হবে, যদি তুমি রাজি থাকো ?


নারী : হ্যাঁ, আমি তোমাদের লিবারেশন ফোর্সে যোগ দিতে চাই, কিন্তু একটা শর্ত আছে, আমি যা যা বলবো তোমাকে তার সঠিক উত্তর দিতে হবে, যদি একটু ভুল করো তবে আমার পিস্তলের গুলি তোমার মাথার খুলিকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে এক সেকেন্ড দেরি করবে না |


সুবীর : ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে হাঁ..হাঁ...আমি যা যা জানি সব বলবো, সব ঠিক ঠিক বলবো |


নারী : তুমি কত বছর ধরে কোথায় কোথায় কাজ করছো ?


সুবীর : আমি একটা লিবারেশন ফ্রন্টে বা মুক্তি বাহিনীতে পাঁচ বছর ধরে যুক্ত আছি | ছোটোখাটো পাহারাদারের কাজ করতাম, আমাদের চিফ বা হেড যার আসল নাম আমরা কেউ জানিনা সে বলেছিলো যতদিন না পর্যন্ত আমি বড়ো কিছু করে দেখাতে পারছি, ততদিন আমার কোনো উন্নতি হবে না | এতদিন পরে আজকে আমি একটা বড়ো সুযোগ কাজে লাগিয়ে একজন এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট বড়ো কমান্ডোকে পিছন থেকে গুলি


করে খতম করে দিয়েছি | শুনামাত্র আমাদের চিফ আমাকে এরিয়া কমান্ডার বানিয়ে দিয়েছে ; আমি সেই মৃত কমান্ডোর AK-47 রাইফেলটা জঙ্গলে একটা গর্ত করে রেখে এসেছি | কাল যখন ওটা নিয়ে আমাদের চিফ বা রাজাসাহেবের কাছে যাবো তখন আমি বলবো আমাকে এরিয়া কমান্ডার নয়, এই এলাকার হেড বানিয়ে দিতে, তুমিই বলো আমি তো ছোটোমোটো কাজ করিনি | আমি সেই অসাধারণ কমান্ডোকে খতম করেছি যে গত দুদিনে আমাদের মুক্তিবাহিনীর পাঁচজনের তাজা প্রাণগুলো নিয়ে নিয়েছে । আমাদের হেড কোয়ার্টারটা প্রায় 50 কিলোমিটার দূরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে, সেখানে আট শো জন মুক্তি বাহিনীর সদস্য আছে যাদের মধ্যে কিছু মহিলাও আমাদের সাথে কাজ করে সবসময় | তুমি যদি আমাদের ফোর্সে যোগদান করো, তবে আমি তোমাকে গাইড করব এবং পুরোপুরি সমর্থন করব যাতে করে তোমাকে আমাদের মহিলা ব্রিগেডের প্রধান করে দেওয়া হয় । আমাদের এই ফোর্সটা অনেক মহান আর আমি তোমার সাথে এই ফোর্সে কাজ করলে আমাদের দুজনের জীবন বেশ সুন্দররভাবে গড়ে উঠবে |


নারী : আমাকে কি কি করতে হবে ?


সুবীর : সে সব কাজের নিয়ম আগে তোমাকে শেখানো হবে ; ভয় নেই আমি তোমার পাশে পাশে থাকবো | তুমি যখন এখানে যোগ দিচ্ছ তখন তোমাকে লিখে দিতে হবে এই মুক্তিবাহিনীর সদস্যরাই তোমার সব ; তোমার মা-বাবা, আত্মীয়-পরিজন কেউ নেই, তোমার ভালো-মন্দ সব কিছুই নির্ভর আমাদের লিবারেশন ফোর্সের ভালো-মন্দর ওপর | অবশ্য তুমি কখনো নিজেকে একা ভাববে না ; এই যে ধরো তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় হলো, এখন থেকে আমি সব সময় তোমার পাশে পাশে থাকবো,


তোমাকে সাহায্য করবো ; দেখো, আজ থেকে আমারও কেউ নেই.., এই মা টা যে ছিলো তাকেও শেষ করে দিয়েছি | তুমিও জানবে আমি তোমার সব, আর আমার জন্য তুমিই সব |


নারী : বাম হাত দিয়ে 9 mm পিস্তলের স্লাইডটা টেনে ধরতেই ম্যাগাজিন থেকে বুলেট চেম্বারে এসে ফায়ারিংয়ের জন্য লোড হয়ে যায় | ডান হাতের আঙ্গুল ট্রিগারে যাবার আগেই......


সুবীর : চিৎকার করে...এই...এই..এই...তুমি এ কি করছো ? কে তুমি ? কেন আমাকে মারতে চাইছো ?


নারী : আমি একজন দেশদ্রোহীকে মারতে এসেছি ; আমি কে জানতে চাইছো ? আমি দেশপ্রেমী কমান্ডো যাকে তুমি অন্যায়ভাবে আজ মেরেছো তার স্ত্রী | তোমাকে কেন মারতে চাইছি ? একজন কুলাঙ্গার সন্তান যে মাতৃহন্তা, যে ভারতমাতার দুশমন, তাকে যমলোকে পাঠিয়ে ভারতমাতাকে কলুষমুক্ত করছি | তোমার জন্য আমি একটির বেশি দুটি গুলি খরচা করতে রাজি নয়, তোমার মতো একটা শয়তানকে মারতে একটার বেশি গুলি খরচ করলে সেটা গুলির অপমান ; যদি একটা গুলিতে না মরো, তবে জানবে তুমি বেঁচে গেলে |


হঠাৎ একটা লাফ দিয়ে সামনে এসে রোশনীর হাত থেকে পিস্তলটা কেঁড়ে নিতে গেলে………কপালের মধ্যিখানে বুলেটটা ছেদ করে সোজা বাইরে এসে টিনের দরজা ভেদ করে বেরিয়ে যায়; সাথে সাথে কপাল থেকে ফিনিকি দিয়ে রক্তের স্রোত এসে রোশনীর চোখে মুখে লাগে এবং গোটা মুখটা রক্তে লাল হয়ে যায় | সুবীরের লাশটা মাটিতে লুটিয়ে পরে, রোশনী হো....হো....করে হেসে উঠে দুহাত তুলে | এক ভ্যান


পুলিশের সাথে দশ-বারোজন কমান্ডা সঙ্গে মিস্টার জোসেফ এসে রোশনীকে সসম্মানে গাড়িতে করে বসিয়ে নিয়ে চলে যায় |


অনেক বছর পেরিয়ে গেছে, রোশনী বর্তমানে একজন সফল কমান্ডিং অফিসার, যিনি বীরত্বের জন্য অনেক পদক অর্জন করেছেন যেগুলো ইউনিফর্মে ঝোলানো, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মার্চ করে এগিয়ে অমর জ্যোতিতে শহীদদের প্রতিমূর্তিতে মাল্যদান করে স্যালুট দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে একটা চেয়ারে বসে ; ওনার পিছন পিছন অনুসরণ করে এক তরুণ সুশ্রী কমান্ডো সে ও শহীদদের সালাম করে ওঁর পাশের চেয়ারটাতে বসে ; আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "এত তরুণ কমান্ডো আপনার মতো এক সিনিয়র কমান্ডিং অফিসারের পাশে বসে, উনি কে ?" শিশুর মতো সরল পরিতৃপ্তির হাসি হেসে রোশনী বলে উঠলো, "এ প্রকাশ, আমার একমাত্র সন্তান," বিস্মিত হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম, "আপনি ও আপনার ছেলে উভয়েই কি যোগ দিয়েছিলেন........, কিন্তু কেন ?


রোশনী : আমি তো আমার স্বামী সুরজকে নিজেই বলতাম একুরিয়ামের মাছের মতো বেঁচে থাকার নাম জীবন নয়, দেশ ও সমাজের জন্য যদি কিছু করতে হয় তবে ফৌজি জীবনের থেকে বড়ো উৎসর্গ আর কিসে হতে পারে | আমি যোগ দিয়েছিলাম সুরজের প্রতি আমার ভালোবাসা অক্ষুন্ন রেখে স্বামীর অপূর্ণ কাজকে পূরণ করা এবং দেশের মাটিকে ভালোবাসার জন্য ; স্বদেশ সেবাই হচ্ছে শ্রেষ্ট সেবা | প্রকাশ একটু বড়ো হয়ে যখন NDA তে সিলেক্ট হলো, তখন আমাকে বললো, "তুমি যদি বাবার অপূর্ণ কাজকে পূরণ করবার জন্য ফৌজে যোগ দিতে পারো, তবে তোমার অপূর্ণ কাজগুলো আমি কি পূরণ করতে পারি না ?" আমি আর ওকে বাধা দিতে পারিনি |" জীবনের উদ্দেশ্য কি শুধু ছেলেমেয়েদের মানুষ করে


অর্থ উপার্জনের মেশিন তৈরী করে ব্যাঙ্ক ব্যালান্স বাড়ানো ? আমরা যদি সবাই তাই করি, তবে আমাদের মাতৃভূমিকে বাঁচিয়ে রাখবে বা রক্ষা করবে কারা ?


আমি বললাম আমরা তো মুভিতে কত নকল নায়ক-নায়িকাদের দেখি, কিন্তু আপনার মতো একজন বাস্তবের মহান নায়িকা এবং যিনি নায়কও, এর আগে কখনও কোথাও দেখিনি বা শুনিনি | আমার মনে হয় কেন আপনাদের এই ধরনের উৎসর্গকে মুভিতে দেখিয়ে দেশমাতৃকার সেবায় দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হবে না ?


রোশনী : আমরা দেশের জন্য নিজেদের বলিদান দোবো, এটাই যদি আমাদের জীবনের আদর্শ এবং সংকল্প না হয়, তবে মুভিতে কি আসে যায় ? আর মুভি তো নাটক বা অভিনয়, কিন্তু আমাদের সৈনিকের জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত বুলেটের গুলিতে লেখা মৃত্যুর হাতছানি | দেশের জন্য লড়াই করবো, যুদ্ধ জয় করবো এবং প্রয়োজনে প্রাণত্যাগ করবো এটাই আমাদের চিরসংকল্প এবং এই স্বদেশ সেবাই জগতের শ্রেষ্ট সেবা |


প্রকাশের নির্দোষ কিন্তু গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখমন্ডলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করি তুমি কিছু বলবে ?


প্রকাশ : আমি মা-বাবার মতো মহান যোদ্ধা হতে চাই ; আমার দুটো মা আছে ; একজন যিনি আমার পাশে বসে আছেন, আর একজন আপনার, আমার , সবাইয়ের মা Mother India বা ভারতমাতা ; আমি আমার উভয় মাকেই স্যালুট দিয়ে দুটো শব্দ প্রতিদিনই বলি," জয় হিন্দ |”


সুরজ ছাড়া রোশনী হয় না, রোশনী ছাড়া প্রকাশ বা আলো কিভাবে হবে ? আমিও স্যালুট দিয়ে বলছি,"জয় হিন্দ |"


Fear is a big weakness of human । ভয় মানুষের সবথেকে বড় দুর্বলতা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ