Looking For Anything Specific?

ads header

অচিন পাখির চিঠি - বাংলা প্রেমের গল্প - হিমাংশু চৌধুরী | Achin Pakhir Chithi - Bangla Premer Golpo By Himansu Chaudhuri

অচিন পাখির চিঠি - বাংলা প্রেমের গল্প - হিমাংশু চৌধুরী | Achin Pakhir Chithi - Bangla Premer Golpo By Himansu Chaudhuri 

bangla premer golpo pdf, bangla premer golpo pdf free download, bangla premer golpo facebook, bangla premer golpo book, bangla premer golpo written, bangla premer golpo read, bangla premer golpo romantic, bangla premer golpo fb, bangla premer golpo app, pratilipi bengali premer golpo, romantic bangla premer golpo, best bangla premer golpo, bangla romantic premer golpo pdf, bangla romantic premer golpo mp3, bangla short premer golpo, bangla film premer golpo, bangla sad premer golpo, bangla bertho premer golpo, bangla koster premer golpo,



সুচরিতাসু,



তোমার মনে আছে কিনা জানিনা, বা হয়তো জানতে চাইও না, সেই আশ্চর্য দিনগুলোর কথা! যখন প্রতিটি সকাল শুরু হতো একটা রূপকথার মতো। যখন খুব ধীরে, যেমনভাবে আমরা লেবু লজেন্সের মোড়ক খুলি সন্তর্পণে, পাছে খোলার সময় হাত পিছলে লজেন্সটা না গায়েব হয়ে যায় পাহাড়ি পথের পাশের অতল খাদে, বা, ঘোর দুপুরবেলায় যখন কুয়াশা এসে হাইডেল প্রোজেক্টের টারবাইনের মাথাগুলো হঠাৎ ঢেকে দিতো! বোঝা যেতো না, জলের যে সূক্ষ্ম কণাগুলো, যেগুলো মেঘের মতো করে উঠে যেতো উপরে, বা পাশের রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের চুলের উপরে মিহি আস্তরণ ফেলে দিতো নিমেষে, তেমনি, নিঃশব্দে অথচ চুপিসাড়ে রাত শেষ হয়ে সকাল হতো আমাদের ঐ মায়াবাসভূমিতে। সারাটা বছরই আমাদের শীতকাল, কিন্তু শীতকালটা বিশেষ করে শীতকাল ছিলো সেখানে। আমি আমাদের সি টাইপ বাংলো থেকে ঘুম চোখে বেরিয়ে আসতাম বাইরে। মাথা থেকে পা অবধি ঢাকা, শুধু চোখ দুটো খোলা। আর তোমাদের এ টাইপের বাংলো ছিলো আমাদের বাংলো যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক তারই পিছনে। মাঝে শুধু একটা পাহাড়ি ঝোরা, এপ্রিল মে মাস ছাড়া সবসময়ই গুনগুন করতে করতে বয়ে যেতো। সেই বাংলোর দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে তুমি। তোমারও আপাদমস্তক মোড়া থাকতো শীতবস্ত্রে, তোমারও শুধু দুটো উজ্জ্বল আর ছটফটে দুটো চোখ থাকতো খোলা!



জানো সুনয়না, আমি এখনো চোখ বন্ধ করলেই তোমার সেই মায়াবী চোখদুটো পরিষ্কার দেখতে পাই। চকিতপ্রেক্ষণা, উৎসুক, কৌতূহলী, আশ্চর্য সুর্মার মতো কালো আর গাঢ় খয়েরির অসম্ভব মিশেল, আর, সর্বোপরি, কৌতুকোজ্জ্বল। প্রথম কিছুদিন দূর থেকে ভাবের আদানপ্রদানই হলো শুধু, কথা হলো না। তুমি সদ্য বদলি হয়ে আসা বড়সাহেবের মেয়ে, ভারী শহর থেকে এসেছো, সেখানে এই এত্ত বড় বড় বাড়ি, আকাশ দেখা যায়না মোট্টে, বর্ষাকালে রাস্তায় জমা জলে তুমি কাগজের নৌকো ভাসাও, তোমার চুলে পনিটেল আর গোলাপি ফুলওয়ালা হেয়ার ব্যান্ড। আর আমি, ক্যাশিয়ার বাবুর একাবোকা ভাবুক খোকা, ঘাসের ফাঁকে প্রজাপতির নাচন দেখে আর পাহাড়ি ঝোরার পাথরের নীচ থেকে রঙিন কাঁকড়া ধরে দিন কাটাই। আমার সাধ্য কি, তোমার সাথে যেচে ভাব করি!



প্রথমে কথা হওয়ার আগেই কিন্তু আমি তোমার পা ছুঁয়েছিলাম, তোমার মনে আছে?। একদিন সকালে আমি তুমি নির্বাক দাঁড়িয়ে আছি ঝোরার দু'ধারে। ধীরে ভোরের আলো ফুটছে, আকাশ অপার্থিব চিতিহাঁসের ডিমের কুসুমের মতো কমলা রঙে ভরে যাচ্ছে, দূরে পাহাড়ের গা বেয়ে কুয়াশার চাদরটা কে যেন সরিয়ে নিচ্ছে আস্তে আস্তে, হাইডেল প্রজেক্টের ড্যামের উপরের অন্ধকারটা কেটে গিয়ে নরম স্লেটরঙা আকাশ ফুটে উঠছে। দু'চারটে মৎস্যভুক শিকারি পাখি ইতস্তত উড়ে বেড়াচ্ছে, আবার হঠাৎ কখনো কোন অদৃশ্য সংকেতে তীর বেগে ছোঁ মারছে নীচের দিকে, টারবাইন চলার গুমগুম আওয়াজ হয়ে চলেছে নিরন্তর, এই আওয়াজটা বেলা বাড়লে অন্য আওয়াজের পিছনে ঢাকা পড়ে যায়, কিন্তু এখন সাতসকাল, চারিদিকে অন্য কোন আওয়াজ নেই, তাই, কালের ঘন্টার মতো এই আওয়াজটা শোনা যাচ্ছে। আকাশের কমলা রঙটা ধীরে ধীরে হলুদ হয়ে সাদা হয়ে গেলো। বাউণ্ডুলে মেঘগুলো হঠাৎ হঠাৎ ছটফটানো বাছুরের মতো এদিক ওদিকে ঢুকে পড়ছে। এদের দেখেই বোধহয় কবি লিখেছিলেন, এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে! 



সুতনুকা, সেই অপার্থিব সকালে যখন মুগ্ধ হয়ে আমরা দু'জনেই শীতের ওম গায়ে মেখে নিতে নিতে, লানটানা ফুলের তীব্র হলুদ রঙের সাথে চোখ সইয়ে নিতে নিতে, ঘাসের ডগার উপরে জমে থাকা ঈষৎ বরফালি শিশিরের গলে যাওয়া দেখতে ব্যস্ত, তখন হঠাৎ তুমি আর্তনাদ করে উঠলে। আমি চমকে তাকিয়ে দেখি, তুমি এক পায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আর একটা পা ছুড়ে ছুড়ে কিছু একটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছো, আর মুখ থেকে অব্যক্ত আর্তস্বর বেরিয়ে আসছে। আমি চকিতে পাথরের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে তোমার সামনে গিয়ে বললাম, 'কি হয়েছে?' আতঙ্কে তোমার মুখ দিয়ে আর কথা ফুটছেনা, তুমি খালি আঙুল দিয়ে ইশারা করে নিজের পায়ের দিকে দেখালে। আমি তাকিয়ে দেখি, সেই শঙ্খধবল পায়ের মাঝের আঙুলে একটি কালো রঙের আংটির মতো পেঁচিয়ে রয়েছে একটি জোঁক।



সুনন্দা, আমি চিত্রার্পিতের মতো কালো সাদা, বিউটি এন্ড দা বিস্টের এই যুগলবন্দী দেখছিলাম, যখন তুমি আবার আর্তনাদ করে উঠলে। আমি বললুম, 'চুপটি করে দাঁড়াও।' কিন্তু বিজুরি কি থির হয়! কোনরকমে চেপেচুপে দাঁড় করিয়ে আমি আঙুল দিয়ে জোঁকবাবাজীকে ছাড়াতে গিয়ে দেখি, তিনি তোমার রক্তপান করে এতটাই স্ফীত হয়েছেন যে আমি হাত দিতেই ফটাস করে ফেটে গেলেন আর সাথে সাথে তাজা রক্ত বেরিয়ে তোমার পায়ের পাতা আর আমার আঙুল একই সাথে লাল হয়ে গেলো। তা দেখে তুমি দ্বিগুণ জোরে চিৎকার করে উঠলে। আমি এক ছুটে ঝোরা থেকে আঁজলা করে সেই বরফগলা জল এনে তোমার পা ধুইয়ে দিলাম। ক্লাস এইটের অ্যানুয়াল পরীক্ষায় আমি সদ্য সদ্য সরস্বতী বন্দনা রচনা লিখে এসেছি। আমার মনে হলো, আমি তোমাকে পাদ্য-অর্ঘ্য দিলাম!



সুচেতনা, ঠিক তখনই তোমার বাবা তোমার চিৎকার শুনে বাইরে বেরিয়ে এলেন। কি ঘটেছে দেখে নিয়ে দরাজ গলায় হাহা করে হেসে উঠলেন তিনি। আমাকে আমার বাবার নাম জিজ্ঞেস করলেন, আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন, তারপর বললেন, "ওয়েল, ইয়ং ম্যান, কাম, হ্যাভ সাম টি উইথ আস। অপা, তুমি ধৃতিমানকে ভিতরে নিয়ে যাও।"



অপাবৃতা সেনগুপ্ত। তোমার নাম আমি সেই প্রথম জানলাম।কিরকম ছন্দোবদ্ধ নাম! আমি বারবার উচ্চারণ করি আর মনে হয় যেন কবিতা পড়ছি। ধীরে তোমার সাথে আলাপ পরিচয় হলো। ক'দিন পরে স্কুল খুললে দেখলাম তুমি আমার ক্লাসেই ভর্তি হলে। ক্লাস নাইন। হাইডেল প্রজেক্টের স্টাফেদের পুত্রকন্যাদের পড়ার জন্যেই এই স্কুল তৈরি। পাশাপাশি বাড়ি হবার সুবাদে এবং এই প্রান্তিক পাহাড়িয়া জায়গায় আমার থাকার স্থায়িত্ব তোমার থেকে দু'বছর বেশি হবার সুবাদে আমি তোমার অভিভাবক হয়ে উঠলাম। তোমাকে সাথে করে ইস্কুলে নিয়ে যাওয়া, ছুটির পরে তোমাকে সাথে করে নিয়ে আসা, সব আমার দায়িত্ব হয়ে গেলো। আর কি মনোহর দায়িত্ব! 



আমি তোমাকে দেখালাম হাইডেল প্রজেক্টের টারবাইনের উপরে উড়তে থাকা মেঘের মতো জলকণার মধ্যে দিয়ে সূর্যের প্রথম কিরণ পড়লে কি অপূর্ব রামধনুর সৃষ্টি হয়। শীতের শেষে গরমের শুরুতে সামনের লাট্টুপাহাড়ের পিছনদিকে ভ্যালিতে কিরকম রঙবেরঙের ফুল ফোটে, গোটা জায়গাটাকে মনে হয় ফুলের চাদরে কে মুড়ে রেখেছে। বুনো স্ট্রবেরি গাছ থেকে কিভাবে স্ট্রবেরি খেতে হয়। পুটুশ ফুলের ঝাড়, যা থেকে একটা ছোট্ট শুঁটি বেরোয়, সেটা পেকে গেলে জলের মধ্যে ফেললেই বিস্ফোরণ! শুঁটিটা ফেটে গিয়ে বীজ ছড়িয়ে পড়ে চারধারে। আমি তোমাকে চেনালাম ঝুঁটিওয়ালা পাহাড়ি বাজপাখি, নীলকন্ঠ পাখি, কালো বুলবুলি, পাহাড়ি ময়না, সাতরঙা মোনাল, আরো কত কি পাখি! আমি তোমাকে দেখালাম হিমালয়ান জায়েন্ট স্কুইরেল। আমি শেখালাম কি করে পাহাড়ি রাস্তায় দম না হারিয়ে হাঁটতে হয়। হঠাৎ বৃষ্টি এসে গেলে কোন গাছের নীচে আশ্রয় নিতে হবে।



সুচরিতা, দেখতে দেখতে কেটে গেলো কতটা সময়। আমরা বড় হয়ে গেলাম। তোমার বাবা আবার বদলি হয়ে চলে গেলেন অন্য কোন প্রজেক্টে। রঙিন একটা বুদবুদ যেমন ফেটে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়, তুমিও হঠাৎ একদিন অদৃশ্য হয়ে গেলে আমার জীবন থেকে। কিন্তু তোমার অনস্তিত্ত্ব, আমার মনে অস্তিত্বের থেকেও ঘোরতর, গভীরতর দাগ কেটে গেলো। কালে সেই দাগে মাটির প্রলেপ পড়লো বটে, উড়ে আসা আপাত সুখের ধূলিকণা বুজিয়ে দিলো সেই খাত, এমনভাবে, যেন উপর থেকে দেখলে কিচ্ছুটি বোঝা যায়না, দিব্যি চৌরশ জমি, কিন্তু হঠাৎ স্মৃতির হড়পা বান আসলেই ভেসে যায় এধারওধার থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে জমা করা সেইসব নবীন সুখ, বেরিয়ে পড়ে দগদগে সেই দুঃখের খাত।



এসব কথা সব কিছুই যে আমি সেই সময়েই ভেবেছি, তা নয়। সেই সুদূর কৈশোরকালে একটি অপাপ বালক তার একাকি মননে সৃষ্টি করে নিয়েছিলো এক অরূপকথা, যার কথন সে শুনলো সারাটি জীবন, আর সেই রূপকথার পান্ডুলিপিতে নতুন নতুন আখরলিপি সে লিখে চললো আজীবন। এ শুধু তারই জন্য লেখা, এ রূপকথা শুধু তারই কথা। সে গোপনে লেখে আর ততোধিক সঙ্গোপনে মাঝে মাঝে নেড়েচেড়ে ধুলো ঝেড়ে আগাপাস্তলা জানা গল্পটা আবার পড়ে দেখে।



এরপরে যে কি হলো তা আমার আর এখন মনে পড়েনা। মাঝে কালো, শুধু কালো। যখন আবার তোমায় এখন দেখতে পেলাম, তখন দেখছি আমরা আবার যেন কোন মন্ত্রবলে ফিরে গেছি নাম না জানা সেই ছোট্ট পাহাড়ি ঝোরার পাশটিতে, দু'ধারে আমরা দু'জন দাঁড়িয়ে আছি, আর মাঝে বয়ে চলেছে ঝোরা। তুমি হাত বাড়িয়ে দিয়েছো, আমি তোমার কাছে যাবো বলে সবে নেমেছি জলে, হঠাৎ কোথা থেকে ভেসে এলো দু'কূলপ্লাবী জল, আমায় তারা ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। আমি তার মধ্যে ডুবছি, আর ভাসছি, মাঝে মাঝে কোন রকমে মুখ তুলে শ্বাস নিচ্ছি, আমার বুক যেন মনে হচ্ছে ফেটে যাচ্ছে। তুমি ওপার থেকে হাত বাড়িয়ে রেখেছো সুমেধা, আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেও সেই বাড়িয়ে দেওয়া হাত অবধি পৌঁছাতে পারছিনা। অবশেষে, আমি হাল ছেড়ে দিই, স্রোতের হাতে নিজেকে সমর্পণ করে ভেসে যাই অজানার দিকে।



আইসিসিইউ বেড নম্বর ১২ র মনিটারে এতক্ষণ এঁকেবঁকে থমকে থমকে চলতে থাকা লাইনগুলো হঠাৎ ফ্ল্যাট হয়ে গেলো। কার্ডিয়াক মনিটরের পিঁপ পিঁপ শব্দ বন্ধ হয়ে গেলো। শুধু ভেন্টিলেটরের ফোঁস ফোঁস আওয়াজটা বন্ধ হলোনা। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে পেশেন্ট ধৃতিমান বসু'র বেডসাইড থেকে উঠে দাঁড়ালেন বিখ্যাত অঙ্কোলজিস্ট অপাবৃতা সেনগুপ্ত। বড্ড লেট করে ধৃতিকে এনেছিলো ওরা। লাং ক্যান্সার, ছড়িয়ে পড়েছিলো শরীরের অলিতে গলিতে--- অবশেষে মস্তিষ্কেও। অপাবৃতা যখন প্রথম দেখলো ধৃতিমানকে, তখন সে মস্তিষ্কপ্রদাহে বিকারগ্রস্ত! কিচ্ছু করার নেই, প্যালিয়েটিভ থেরাপি দেওয়া ছাড়া। কে জানে, ধৃতির তাকে মনেও ছিলো কিনা, অথবা মনে থাকলেও চিনতে পেরেছিলো কিনা! 



তুমি তো জানতে না ধৃতি, তোমাকে আমি কখনো ভুলিনি। মেয়েরা তাদের প্রথম প্রেম কক্ষনো ভোলে না!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ